'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' জয়ী হয়েছে

অপরাধ করে দায়মুক্ত থাকার এক কৌশল আছে। এই কৌশলপত্র জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রণয়ন করেননি, কিন্তু চলমান একুশ শতকের শুরুর দিকে তাঁর প্রশাসন এটিকে জনপ্রিয়তা ও বৈধতা দেয়। আজকের পৃথিবীতে ওয়াশিংটনের বিভিন্ন মিত্ররা রক্তাক্ত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চালাচ্ছে। তারা কখনো কখনো অনাগ্রহ নিয়ে স্বীকার করে, এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের ঋণ আছে।

সন্ত্রাসবাদ খুবই কার্যকর এক শত্রু। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে এবং যোদ্ধাদেরও চিহ্নিত করতে হবে। ব্যাপারটা হচ্ছে, কাগজে-কলমে কোনো সংঘাতই আইনের বাইরে নয়। কিন্তু সব ক্ষমতাবান মানুষ যদি একমত হন যে অন্ধকারাচ্ছন্ন অরাষ্ট্রীয় গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করতে হবে, তাহলে এর বিধান হিসেবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করা বেশ চৌকস রাষ্ট্রীয় কৌশল।

বুশ ইরাকিদের বিদ্রোহের জন্য নিজের কাজ ছাড়া আর সবকিছুরই সমালোচনা করেছেন। ২০০৫ সালে ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসিকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের কোনো কাজে খুনিরা প্ররোচিত হয়নি।’ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ওপর যখন হামলার পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন তিনি বরং বলেছিলেন, ইসলামি চরমপন্থার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। ‘সিরিয়া ও ইরানের মতো সমমনাদের কারণে এটা ঘটেছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রকে আঘাত করতে চায়।’ যারা নিজেদের সমর্থনের প্রভাব বেশি করে দেখানোর জন্য ‘সন্ত্রাসবাদী প্রচারণা’ ব্যবহার করে থাকে।

বুশ অবশ্য পুরোপুরি ভুল ছিলেন না। কারণ, সিরিয়া জিহাদিদের ইরাকে ঢুকতে সহায়তা করেছে। সে কারণে বুশ প্রশাসন সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের দামেস্কে পাঠিয়েছিল, যেখানে তাদের নিয়ম করে পেটানো হয়েছিল। যদিও তারা বাশার আল-আসাদের সরকারের সমালোচনা করেছিল। ইরানও ইরাকি বিদ্রোহীদের সহায়তা করেছিল। কিন্তু এই বিদ্রোহ তো এরা তৈরি করেনি। ২০০৩ সালের ইরাক অভিযান ও পরবর্তী সময়ের দখলদারির কারণে এটি সম্ভব হয়েছিল। আজ তেহরান ও দামেস্ক উভয়ই সেই পুরোনো সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের বুলি আওড়ায়, তারা সিরিয়ার বিদ্রোহের জন্য বাইরের শক্তিকে দায়ী করে। ইরান নিজেদের ছাড়া অন্যদের দায়ী করে। এদের ব্যাপারে তাদেরও দায় আছে, সেটা তারা মনে করে না।

এর আংশিক কারণ হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের জন্য নানা উপায়ে দুঃখ প্রকাশ করা যেতে পারে। এর জন্য পুনরাবৃত্তি ও অনুকরণ প্রয়োজন। ইসরায়েলে নির্মিত এক ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, এক ইসরায়েলি সেনা মাকে রক্ষা করছে এবং একজন সশস্ত্র ফিলিস্তিনি আরেক মায়ের পেছনে লুকিয়েছে। যারা ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহ্বান জানায়, তারা এটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। অন্যদিকে সিরিয়ার আসাদ ও মিসরের সিসির অনুগত ব্যক্তিরাও একই উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করে। এরা উভয়েই নিজস্ব ঢঙে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ পরিচালনা করছে। ব্যাপারটা হলো, এই যুদ্ধে বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর কারণ তাদের দেখাতে হচ্ছে। ওদিকে মানুষের হৃদয় হরণকারী সামাজিক মাধ্যম টুইটারে মিয়ানমারের গণহত্যাকারী সামরিক বাহিনী একই ধরনের একটি ব্যঙ্গচিত্র পোস্ট করেছে।

এই সমর্থকেরা শুধু সরকারের কথার প্রতিধ্বনি করছেন না, যে সরকার শুধু নিজের কাজের যুক্তি দিতে চায় না; বরং অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও শক্তিশালী সমর্থন প্রত্যাশা করে। আসাদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছেন, যেটা তাঁর ভাবমূর্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশের সংস্কারের পথ থেকে সরে আসতে তিনি জনগণের ওপর যে বোমা ও গুলিবর্ষণ শুরু করেন, সে কারণেই এই বিদ্রোহের শুরু, যদিও তিনি এর দায় চাপান মার্কিনদের ঘাড়ে। সেই তিনি কেন বুশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এই শব্দবন্ধটি চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত করেননি। যুক্তরাষ্ট্র তখন বলত, আপনি হয় আমাদের সঙ্গে আছেন, না হয় শত্রুদের সঙ্গে।  

তিনি বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার লক্ষ্যে সিরিয়া বহুদিন ধরে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কামনা করে আসছে। সে জন্য যেসব দেশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, আমরা তাদের সহযোগিতা করতে চাই। এই লক্ষ্যে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছি। যারা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আন্তরিক, আমরা তাদের সবার সঙ্গে কাজ করতে চাই।’ সন্ত্রাসবাদ কী বা কে সন্ত্রাসী, তা নিয়ে সব সময়ই বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিবাদকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ আখ্যা দিয়ে তিনি পাঠকের অভ্যস্ত কানের প্রতিই আবেদন রাখলেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আসাদ সরকারের বারবার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আইএস মারা ছাড়া সিরিয়ার ব্যাপারে আমাদের তেমন কিছু করার নেই।’ সিরিয়ায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর জন্য দেশটির সরকারই বেশি দায়ী। আর আইএস মারতে যাওয়া মানে আরও বেশি বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা।

শুধু প্রচারণা ও সামরিক বল দিয়ে চরমপন্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা যায় না। বিদ্রোহ পরাজিত হওয়ার পরও তার পুনরুত্থান হতে পারে, তখন সেটা আরও চরমপন্থী হয়; যদি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা না ঘোচে। কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের যুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও তার আনুষ্ঠানিক শত্রুরা লাইসেন্স পাওয়ার মধ্য দিয়ে ছড়াতে থাকে। যাদের রাজনীতি বৈপরীত্যমূলক প্রপঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তারা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। এর আংশিক কারণ হচ্ছে, যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় মানুষকে অধিকার দেওয়ার জায়গায় ভীতসন্ত্রস্ত করার অধিকার দেওয়া হয়েছে, সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়া রাষ্ট্রগুলো সেটা কাজে লাগাতে পারে।

জাতিসংঘের সদস্য প্রতিটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র এটা শিখে ফেলেছে। আর যুদ্ধ তো ঘটেই চলেছে। ইরাকে সরকার পরিবর্তন করে বুশ সবার মধ্যে স্থিতিশীলতা ও গদিরক্ষার ব্যাপারে উদ্বেগ তৈরি করেছেন। ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনের লাখ লাখ মৃত এবং তার চেয়ে বেশি জীবিত মানুষেরা সাক্ষী, ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ জয়ী হয়েছে।

আল-জাজিরাথেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

চার্লস ডেভিস: লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক লেখক।