শরণার্থী পরিস্থিতি: 'বড় দেরিতে তুমি বুঝলে...'

সন্তানদের নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে পৌঁছেছেন এই রোহিঙ্গা নারী। ছবিটি গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নাইট্যংপাড়া থেকে তোলা। ছবি: আশরাফুল আলম
সন্তানদের নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে পৌঁছেছেন এই রোহিঙ্গা নারী। ছবিটি গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নাইট্যংপাড়া থেকে তোলা। ছবি: আশরাফুল আলম

বিষাদে হোক আনন্দে হোক অরিন্দমেরা এতক্ষণে কথা বলা শুরু করেছেন। টু লিটল টু লেট বলে এই প্রচেষ্টাকে নিরুৎসাহিত না করে বরং মারহাবা মারহাবা বলে কায়মনোবাক্যে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া উচিত। দোয়া, প্রার্থনা করা উচিত যেন এই অবস্থান দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। বিলম্বের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি থাকলেও সময়ের এক ঘা অসময়ের দশ ঘা-জাতীয় বাগধারা নিয়ে তর্ক করার সময় এটা নয়। তবে সব অরিন্দমের কথায় যেন ঐকতান থাকে; একেকজন একেক সুর ভাজলে তা সুড়সুড়িতে পরিণত হতে পারে! সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান মনে পড়ে, ‘বড় দেরিতে তুমি বুঝলে...’।
অফ সিজনেও কক্সবাজার টিকিট এখন মঙ্গা; হোটেল-মোটেল ও থিক থিক করছে দুর্যোগ পর্যটকে। অনেক বেকারের চাকরির শিকে ছিঁড়ছে। কেউ শিবির বদলাচ্ছে—দেশি থেকে বিদেশি সংস্থা সেখান থেকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘ যেখানে যার রুজি জুটছে, করছে। জেনেভা, নিউইয়র্ক, রোম, লন্ডন, থেকে জ্ঞান আর মান নিয়ে ছুটে আসছে বিশেষজ্ঞের দল। একেবারে হই হই কাণ্ড রই রই ব্যাপার। যেন কমলা সার্কাসের তাঁবু পড়েছে কোনো এক মফস্বল শহরের পুলিশ ময়দানে।
খোদ মিয়ানমার থেকে পর্যটকের সাজে ফটোসাংবাদিকদের ভিড়ের সঙ্গে মিশে যাওয়ার উদ্বেগজনক খবর ও তার বারতাও ভাসছে। আমাদের দু-একজন শরণার্থীদের ফিরতি নৌকায় ‘নো ম্যান্স’ ল্যান্ডের ওপারে দু-এক কদম হেঁটে আসার দুঃসাহসী অভিযানের বর্ণনা বিদেশি গণমাধ্যম গনগনিয়ে প্রচার করছে।
এর মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভার ঘণ্টা বেজেছে। অনেকের বিশ্বাস এ ঘণ্টায় হবে ঘণ্টা। সাধারণ পরিষদেও বিষয়টি উঠবে। আশা করি, আমাদের নীরব কূটনীতির অন্তঃসলিলা গতি তীক্ষ্ণ হবে—এ উপলক্ষে তথ্য-উপাত্তসহ এক পাতা দুই পাতা মর্মকথা নানা ভাষায় বিলি করবে সদস্যদের মধ্যে। ওআইসির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছাড়াও বাংলাদেশ ওআইসির মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য গঠিত কন্টাক্ট গ্রুপেরও অন্যতম সদস্য। তা ছাড়া আসিয়ান সদস্য ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার সঙ্গেও এ কাজে গাঁটছড়া বাঁধতে পারে বাংলাদেশ। সার্কের ছোট শরিক মালদ্বীপকেও পাশে পেতে পারি আমরা। মালদ্বীপ ইতিমধ্যেই বেশ কড়া অবস্থান নিয়েছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে। কথিত মুসলিম দেশ হলেই যে সে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াবে তা কিন্তু নয়। পাকিস্তান, আফগানিস্তান যার যার ইমামের পেছনেই দাঁড়াবে। চীন আর মার্কিনদের অনুমোদন ছাড়া সেখানকার গাছের পাতাও নড়ে না। তারা বড়ই মজবুর, অসহায়। তবে চাপ ওই দুই দেশেই বাড়ছে। লাহরে, করাচিতে মিছিল হয়েছে বাংলাদেশের অবস্থানের সপক্ষে। আমাদের কোনো কোনো বুদ্ধিমানের সঙ্গে সে দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিমানদের দিলের লেনাদেনা এ ব্যাপারে কাজে লাগানো যায়। সব কাজ কি সরকার একাই করবে? ‘সিভিল সোসাইটি’র গম্ভীর গম্ভীর মানুষগুলো একটু নড়ে চড়ে বসলে ক্ষতি কি?
মমতা, মুখার্জি, মণিশংকর, সীতারাম, মানিক, বুদ্ধদেব, দশরথ, নৃপেন, মেনন, প্রকাশ, বৃন্দা—এঁদের সঙ্গে এ দেশের যাঁরা বাসায় আসা-যাওয়ার সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্য মজলিশে ঢেকুর তোলেন, তাঁরা গিয়ে একবার তাঁদের সঙ্গে দেখা করে লোকসভা-রাজ্যসভায় মিয়ানমারের মিয়াদের বিরুদ্ধে কথা বলতে রাজি করান না কেন? তাতে এ দেশের সরকারের কিছুটা মুশকিল আসান হবে।
চীনে শিগগিরই একটি সরকারি প্রতিনিধিদল যাবে; সরকারের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি পর্যায়ও বিশেষ করে ভারত আর চীনের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কথা বলাটা খুবই জরুরি। না হলে জলও পড়বে না পাতাও নড়বে না। এবার আমাদের সাড়া বিলম্বিত করলেও প্রতীক্ষা বিলম্বিত করা যাবে না। মায়া, দয়া, অধিকার, মমতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, যা দিয়েই আমরা শরণার্থীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিই না কেন, আমাদের বিপদ কিন্তু অন্যদিকেও আছে।
ভোট, রাজনীতি, ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র—এসব সেই বিপদের কাছে অতি তুচ্ছ। নেই নেই করে এ যাবৎ আমাদের সবচেয়ে ঈর্ষণীয় অর্জনগুলো রাঙামাটির পাহাড়ধসের মতো লুটিয়ে পড়বে যেকোনো সময়।
শিশুমৃত্যু হার কমাতে গিয়ে জনস্বাস্থ্যের গুণগত মান অর্জন করতে গিয়ে আমরা যেসব ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছি, তাতে আঘাত আসবে। মিয়ানমারে এখনো পোলিও হয়। যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া সেখানে ডালভাত। পোলিও ছড়ায় মানুষের মলের সঙ্গে। মিয়ানমার থেকে আসা মানুষগুলোর জন্য মানসম্মত পয়োনিষ্কাশন, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, নিরাপদ পানীয় জলের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ছাতা তৈরি করতে না পারলে আমাদের জনস্বাস্থ্য-ব্যবস্থায় চিড় ধরতে পারে।
পোলিও ছড়ানোর খবর একবার রাষ্ট্র হলে আমাদের রপ্তানি-বাণিজ্যে স্থায়ী ছেদ পড়বে। জাতিসংঘ, জেনেভা, রোম, প্যারি যেখানে আমরা যত হাতি-ঘোড়া বশ করি না কেন, দেশে একটি সুনিয়ন্ত্রিত কিন্তু স্বচ্ছ শরণার্থী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। দুষ্টু আর নিন্দুকেরা বলতেই পারে, যারা হাজার কয়েক হাজির ব্যবস্থাপনায় বছরের পর বছর গোল্লা খায়, যারা মালয়েশিয়ার পাঠানো রিলিফ নিজের ভোটারদের মধ্যে সচিত্র বিলি-বণ্টন করে, তারা দশ লাখ শরণার্থীর ন্যায্য ব্যবস্থাপনা করবে কীভাবে?
এসব শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমরা দেশের মানুষ দিয়েই এ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। বাংলাদেশের শত শত মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খুব দক্ষতার সঙ্গে শরণার্থী আর সংকট মোকাবিলার কাজ করছে। রাষ্ট্র ডাকলে তারা আসবে না এটা আমার বিশ্বাস হয় না।
শরণার্থীদের প্রতি গ্রহীতা সমাজ সব সময় একটু আড়চোখে তাকায়। ছোট চোখে দেখে; মনে করে, আমার রুটিরুজিতে ভাগ বসাবে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর যারা এ দেশে এসেছিলেন, তারা এখনো ঘটি, আর যারা ভারতে গেলেন, তারা এখনো বাঙ্গাল। বিয়েশাদি, খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলা—সবই হচ্ছে কিন্তু সুযোগ পেলে হাসিঠাট্টার ছলে হলেও দুকথা শুনিয়ে দিতে কেউ কসুর করে না। ঘটি বরকত ভাষা আন্দোলনে রক্ত দিলেও তাঁদের ঘটিত্ব ঘোচে না। জ্যোতি বসু বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হলেও ফুটবল সমর্থকের ঘরানায় তাঁরা মোহনবাগান নন—ইস্টবেঙ্গল হিসেবেই তাঁদের ধরা হয়। শরণার্থীরা একটু ভালো থাকলে, একটু ভালো খেলে আমাদের অনেকেরই জ্বলে। মনে আছে, আগরতলার সিনেমা হলে চলন্ত সিনেমা বন্ধ করে লাইট জ্বালিয়ে আগরতলার তদানীন্তন এসডিও দর্শকদের মধ্যে থাকা জয় বাংলার লোকদের প্রায় গালি দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে যুদ্ধের মাঠে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছিলেন। ঘরবাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষ শুধু বসে বসে কাঁদবে—এটাই অনেকের আশা। তারা কাঁদবে, হাসবে, খেলবে তা দেখে আমাদের জ্বললে চলবে না। যে মানসিক চাপ নিয়ে তারা বেঁচে আছেন, তার থেকে মুক্তির উপায় হলো স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথগুলো খোলা রাখা।
বিনোদন মানুষের অধিকার—শিশুদের, কিশোর-কিশোরীদের খেলাধুলা আর শৈশবকালীন কর্মকাণ্ড চালাতে না দিলে বিপদ অন্যদিকে মোড় নেবে, নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই খবর আসছে, তথাকথিত একটি বেসরকারি সংস্থার কোনো কোনো কর্মী শরণার্থী শিশু-কিশোরদের গায়ে হাত তুলছে। এসব বন্ধ হোক। শরণার্থীদের সঙ্গে আচরণের নীতিমালা যার জানা নেই, তাকে যেন কক্সবাজারের টিকিট দেওয়া না হয়।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী