আঞ্চলিক বিভেদে সকলের ক্ষতি

দেশভাগের ৭০ বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু তার রেশ যেন শেষ হওয়ার নয়। শেষ হওয়া তো দূরের কথা, দিনকে দিন তার নতুন মাত্রা যেন আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। গত ১৫ আগস্ট বিবিসি অনলাইনে এক পাকিস্তানি বৃদ্ধের সাক্ষাৎকার দেখলাম। পেশোয়ারের বৃদ্ধটি একরকম গর্বের সঙ্গেই বললেন, দেশভাগের সময় তিনি এক হিন্দু কংগ্রেসি নেতাকে নিজ হাতে হত্যা করেছেন। তাঁর ভাষ্য অনুসারে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে ওই ব্যক্তিকে হত্যা না করলে তিনি নিজের মানুষের কাছে কাপুরুষ হয়ে যেতেন।

বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ার মতো দুঃখজনক ঘটনা মানুষের জীবনে আর কিছু হতে পারে না। যাঁদের জীবনে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাঁরাই শুধু বোঝেন, এর বেদনা কতটা দুঃসহ। দেশভাগের কারণে পরিবার ভেঙে গেছে, মানুষ চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে নতুন জায়গায় গিয়েছে, স্বজন হারিয়েছে। এটা আমাদের বাস্তবতা, এর জন্য কার দোষ বেশি আর কার দোষ কম, সেটা ঐতিহাসিকেরা খতিয়ে দেখছেন। নানা মুনি নানা মত দিচ্ছেন, সে তাঁরা দিতে থাকুন। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, দেশভাগ ও পরবর্তীকালের রাষ্ট্রীয় বৈরিতার কারণে এই অঞ্চল কতটা পিছিয়ে গেল, সেটা আমরা খতিয়ে দেখি না।

পৃথিবীর ইতিহাসে ভূমি নিয়ে মানুষের হানাহানি বহু পুরোনো ব্যাপার। ইউরোপে দীর্ঘকাল ধর্মযুদ্ধ হয়েছে। ওয়েস্টফালিয়া চুক্তির মাধ্যমে তারা আপসরফা করে নেয়। এরও বহুকাল পর জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের বোধোদয় হয়। জাতিরাষ্ট্রের প্রভাব কমানোর জন্য ওই সময় তারা নানা রকম সহযোগিতা কাঠামো তৈরি করে, যার ধারাবাহিকতায় শেষমেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হয়। ইউনিয়ন গঠনের পর মানুষের অবাধ চলাচল নিশ্চিত হয়েছে, যদিও ব্রেক্সিটের কারণে তা বড় ধাক্কা খেয়েছে। উপমহাদেশের মানুষেরা একই অঞ্চলভুক্ত, আমাদের চেহারা ও সংস্কৃতিতে এত মিল—অথচ আমরা পরস্পরকে কত কম জানি! আমাদের যোগাযোগে বিস্তর বাধা।

দেশভাগের পর ভারত-পাকিস্তান ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলো, সেই ধারায় চলতে চলতে তারা এখন ব্যর্থ রাষ্ট্রের পর্যায়ে চলে গেছে। তার সঙ্গে আছে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ। দেখা যায়, পাকিস্তানের কোনো সরকার যখনই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করে, তখনই নানা কারসাজি শুরু হয়। নওয়াজ শরিফ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আদালত কর্তৃক অযোগ্য ঘোষিত হয়ে তাঁকে সরে দাঁড়াতে হলো। ভারতেও ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার মুসলিম বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। অর্থাৎ উভয় দেশের একটি গোষ্ঠী ক্ষমতার লোভে বিদ্বেষ ও ঘৃণা জিইয়ে রাখছে।

স্বাধীনতার পর পাকিস্তান দীর্ঘ সময় সেনাশাসনে ছিল। ফলে সামরিক খাতে তারা বিপুল ব্যয় করেছে। দেশটির সাবেক অর্থ উপদেষ্টা শহিদ জাভেদ বারকি বলেছেন, পাকিস্তান যদি জিডিপির সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ পর্যন্ত সামরিক খাতে ব্যয় করত, তাহলে তার জিডিপির আকার বর্তমানের দেড় গুণ বেশি হতো। ২০১৬ সালে তারা সামরিক খাতে জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় করেছে। ১৯৬৬ সালে তারা সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের শিক্ষা ও সামাজিক খাতে ব্যয় কমাতে হয়েছে।

অন্যদিকে আমাদের ব্যাপারটা একটু জটিল। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সরকারের সময় ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ধরন একেক রকম ছিল—এসবই ঘটেছে রাজনৈতিক কারণে। সামগ্রিক ও আঞ্চলিক স্বার্থের বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পায়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মুক্ত চলাচল ব্যাহত হয়েছে। তাতে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসই শুধু বেড়েছে, আর কিছু না হলেও।

শুধু উপমহাদেশই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বেলায়ও একই কথা খাটে। ওদিকে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দা-কুমড়া পর্যায়ের। চীনকে বাদ দিলে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ১৭০ কোটি মানুষের বসবাস। নতুন পৃথিবীর বড় বাজার হওয়ার সম্ভাবনা আছে এ অঞ্চলের। অথচ আমরা এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছি না।

দ্য ইকোনমিস্ট  সাময়িকীর সূত্রে জানা যায়, পৃথিবীতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয় সবচেয়ে কম। প্রতিবেশী দেশগুলো ভারতের আমদানির মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ জোগান দেয়, যেখানে ভারতের রপ্তানির মাত্র ৪ শতাংশের গন্তব্য এই দেশগুলো। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরী সম্পর্কের কারণে তাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ৩০০ কোটি ডলারেরও কম...এটা শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, কূটনৈতিক সমস্যাও বটে। এই যোগাযোগহীনতার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বিপুল, যদিও এটি পৃথিবীর অন্যতম বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। এক হিসাবে বলা হয়েছে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতা না থাকলে তাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১০ গুণ বাড়ত। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের মধ্যে নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৬৫ শতাংশ, যেটা নাফটার ক্ষেত্রে ৫১ শতাংশ ও আসিয়ানের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ। আর সাফটার (সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ৫ শতাংশ। বোঝাই যায়, আমাদের বিচ্ছিন্নতা কোন পর্যায়ের।

মোদ্দাকথা হলো, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক ও সমন্বিত অর্থনীতি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। নানা শুল্ক ও অশুল্ক বাধার কারণে এই আঞ্চলিক অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে না। যোগাযোগ ও অবকাঠামোর অপ্রতুলতা এবং বিনিয়োগ সীমাবদ্ধতাসহ নীতিগত দুর্বলতাও এর বড় কারণ। ব্যাপারটা এ পর্যায়ে চলে গেছে যে ভারতের পক্ষে পাকিস্তানের চেয়ে ব্রাজিলের সঙ্গে বাণিজ্য করা ২০ শতাংশ সাশ্রয়ী! আর এসবের পেছনে কাজ করছে মূলত রাজনৈতিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস। এখানকার দেশগুলোর আয়তন ও শক্তির পার্থক্য যার একটি কারণ। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, এসব বাধা দূর করা গেলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার থেকে ১০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে। তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বেড়েছে। ধারণা ছিল, ট্রানজিট চুক্তি হওয়ার পর তা গাণিতিক হারে বাড়বে। কিন্তু ট্রানজিটের অবস্থা অত্যন্ত হতাশাজনক। চার দেশের মধ্যকার বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল) চুক্তি হলো না। সার্কও কার্যকর হচ্ছে না।

রাজনৈতিক বিবাদ যা-ই থাকুক না কেন, সেটা পাশে ঠেলে উপমহাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়াকে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। মানুষের যোগাযোগ অবাধ করতে হবে, তাতে অন্তত ব্যক্তি পর্যায়ের সন্দেহ, অবিশ্বাস দূর হবে। সীমান্ত একদম উন্মুক্ত করা না গেলেও বাণিজ্য ও পর্যটনের জন্য তা উন্মুক্ত রাখতে হবে। সামরিক বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হবে। এই দক্ষতা অর্জন করতে না পারলে আমরা একুশ শতকের উপযোগী হতে পারব না। আর তাতে আমাদেরই ক্ষতি। মনে রাখা দরকার, দক্ষিণ এশিয়ার ৪০ কোটি মানুষ এখনো দরিদ্র।

প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক ও অনুবাদক।