আসাদেরই জয় হচ্ছে

রবার্ট ফিস্ক
রবার্ট ফিস্ক

গত সপ্তাহে সিরিয়া থেকে আমার ফোনে একটি খুদে বার্তা আসে, ‘জেনারেল খাদুর কথা রেখেছেন’। আমি জানি, এর অর্থ কী।

পাঁচ বছর আগে এই মোহাম্মদ খাদুরের সঙ্গে আমার দেখা হয়, তিনি তখন আলেপ্পোর এক শহরতলিতে ছোট এক সিরীয় সেনাদলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তখন তিনি আমাকে তাঁর মানচিত্র দেখালেন। তিনি আমাকে বলেন, এই রাস্তাগুলো ১১ দিনের মধ্যে পুনরায় দখল করবেন।

আর এ বছরের জুলাই মাসে খাদুরের সঙ্গে আমার সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলের দূরবর্তী এক মরুভূমিতে আবার দেখা হলো। বললেন, আগস্টের শেষ নাগাদ তিনি অবরুদ্ধ শহর দিয়ের-এজরে ঢুকবেন। আমি তাঁকে কিছুটা নির্মমভাবে স্মরণ করিয়ে দিলাম, শেষবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, ১১ দিনের মধ্যে আলেপ্পো দখল করবেন। কিন্তু সেটা করতে সিরীয় সেনাবাহিনীর চার বছরের বেশি সময় লেগেছে। তিনি বললেন, সেটা তো অনেক আগের কথা। তখন সেনাবাহিনী গেরিলাযুদ্ধের কায়দা রপ্ত করতে পারেনি। সেনাবাহিনী গোলান পুনর্দখল ও দামেস্ক রক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ পেয়েছে। কিন্তু তারা এখন সেটা শিখে গেছে।

হ্যাঁ, তারা সেই প্রশিক্ষণ পেয়েছে। মরুভূমির মাঝে খাদুর বলেন, তিনি সাখনু শহরে বোমা বর্ষণ করতে যাচ্ছেন। তবে রুশ সেনারাই বেশি বোমা বর্ষণ করবে আর তাঁর সিরীয় সেনারা সেখান থেকে দিয়ের-এজরে ঢুকবে, যে শহরটি তিন বছর ধরে ৮০ হাজার সেনা নিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। খাদুর বলেছিলেন, তিনি ২৩ আগস্টের মধ্যে দিয়ের-এজরে পৌঁছে যাবেন। আর এখন তিনি সিরিয়া-ইরাক সীমান্তের অভিমুখে দিয়ের-এজরের বাকি অংশের দিকে যাত্রা করছে। দেখা যাচ্ছে, পশ্চিম এত দিন যেটা অচিন্তনীয় মনে করত
সেটাই এখন ঘটছে। অর্থাৎ বাশার আল-আসাদের সেনারা যুদ্ধ জিততে যাচ্ছে। ব্যাপারটা শুধু মনে হওয়ার পর্যায়ে নেই। হাসান ‘টাইগার’ সালেহ্ নামের সিরিয়ার এক প্রিয় সেনা কর্মকর্তা দিয়ের-এজরের সিরীয় সেনাবাহিনীর ১৩৭ ব্রিগেডে ঢুকে গিয়ে সেনাদের মুক্ত করেছেন। আর হাসানের বন্ধু খাদুর শহরের বিমান ঘাঁটি মুক্ত করেছেন।

এখন আমাদের কতজনের মনে আছে যে মার্কিনরা এই বিমানঘাঁটির কাছে সিরীয় সেনাদের বোমা মেরে ৬০ জনকে হত্যা করেছিল? যার কারণে আইএস শহরটিকে দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিল? সিরীয়রা কখনোই বিশ্বাস করে না মার্কিনরা ‘ভুল করে’ সেখানে বোমাবর্ষণ করেছিল। শুধু রুশ বাহিনীই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিল, তারা সিরীয় সেনাদের ওপর বোমা ফেলেছে।

ব্রিটিশরা মনে হচ্ছে বার্তা পেয়ে গেছে। তারা চালাকি করে গত সপ্তাহে সামরিক প্রশিক্ষকদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যাদের দায়িত্ব ছিল ক্যামেরনের কাল্পনিক ‘৭০’ হাজার বিদ্রোহীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, যারা পরিণামে আসাদকে উৎখাত করবে। এমনকি জাতিসংঘের প্রতিবেদনে যখন বলা হলো আসাদের সরকার গ্যাস দিয়ে ৮০ জন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে, তখনো ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা এতে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। অথচ এঁরা সিরিয়ায় যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কথা বলতেন এবং সিরিয়ার বিমানঘাঁটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অযথা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সমালোচনা করতেন। আর ইসরায়েলের কী হলো? এরা কিন্তু সত্যি আসাদের পতনের দিন গুনছিল। এই আশায় তারা আসাদের ও এমনকি তাঁর মিত্র হিজবুল্লাহ ও ইরানি সেনাদের ওপর বোমাবর্ষণ করেছে এবং ইসরায়েলের শহরে ইসলামি সেনাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছে। ফলে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যে এত ‘উত্তেজিত’ও ‘আবেগী’ হয়ে (রাশিয়ার ভাষায়) হয়ে সোচিতে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। পুতিন বলেছেন, ইরান এই অঞ্চলে রাশিয়ার ‘কৌশলগত মিত্র’। ইসরায়েল রাশিয়ার ‘গুরুত্বপূর্ণ মিত্র’ ছিল। ব্যাপারটা ঠিক একই রকম ছিল না, নেতানিয়াহুও তা শুনতে চাননি।

সিরিয়ার পুনঃ পুনঃ বিজয়ে বোঝা যায়, সিরিয়ার সেনাবাহিনী এ অঞ্চলের সবচেয়ে ‘যুদ্ধ-অভিজ্ঞ’। এর সেনারা নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছে। এখন তাদের সেনা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম সমন্বয়ের প্রশিক্ষণ আছে। সেন্ট অ্যান্টনি কলেজের সাবেক শিক্ষক শারমিন নরওয়ানি এ সপ্তাহে বলেছেন, এই জোট এখন জাতিসংঘের দুই স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ও চীনের সমর্থন পাচ্ছে।

তাহলে ইসরায়েল এখন কী করবে? নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে এতটা আচ্ছন্ন যে তিনি পরিষ্কারভাবে এটা কখনো কল্পনা করেননি, আসাদ জিততে পারে এবং মসুলের ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও শক্তিশালী ইরাকি সেনাবাহিনী তৈরি হবে। নেতানিয়াহু এখনো কুর্দিদের সমর্থন করেন, কিন্তু সিরিয়া, তুরস্ক, ইরান বা ইরাক—এদের কারও কুর্দি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার স্বার্থ নেই। যদিও মার্কিনরা কুর্দি আধা সামরিক বাহিনীকে সামরিকভাবে তথাকথিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সে কাজে লাগায় (এটা মূলত কুর্দি, সিরীয় নয়, এটা মোটেও ‘গণতান্ত্রিক’ নয়, আর মার্কিন বিমান শক্তি ছাড়া তারা ‘বাহিনীও’ নয়’)।

ফলে ট্রাম্প ও কিম জং-উন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দেবেন বলে আমরা যখন অপেক্ষা করছি, তখন আমাদের অলক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক মানচিত্র অনেকাংশে বদলে গেল। ইরাক ও সিরিয়ার পুনর্নির্মাণে অনেক বছর লেগে যাবে। ইসরায়েল তো ওয়াশিংটনের সাহায্য নিতে অভ্যস্ত, কিন্তু তারা যে গাড্ডায় পড়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের আবারও পুতিনের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হতে পারে।

ইসরায়েলের যে ডানপন্থীরা মনে করেন, আইএসের চেয়ে আসাদই বড় বিপদ, তাঁদের পুনরায় চিন্তা করতে হতে পারে। সুনির্দিষ্টভাবে এ কারণে যে উত্তর সীমান্ত নিরাপদ রাখতে আসাদের সঙ্গে তাঁদের কথা বলতে হতে পারে।

দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।