সু চির মেকিয়াভেলকির জবাব দেবে কে?

বক্তৃতায় সু চি বলেন, ‘বিশ্বের নজর আমি ভয় পাই না’। ছবি: এএফপি
বক্তৃতায় সু চি বলেন, ‘বিশ্বের নজর আমি ভয় পাই না’। ছবি: এএফপি

রোহিঙ্গাদের কাটা-পোড়া-ডোবা লাশগুলো আর কথা বলবে না। পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া ২১০টি গ্রামের সাক্ষ্যও মুছে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সাত লাখ রোহিঙ্গার সাক্ষ্য কি নেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত? যে মিয়ানমার তাদের নাগরিকত্ব মানে না, তাদের ফরিয়াদ ওই দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের মাইনপোঁতা সীমান্তে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে থাকে কেবল।
বক্তৃতার ডায়াসে রাখা ফুলগুলোর মতো সুন্দর এক চিত্র সু চি তুলে ধরেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কোনো ‘ক্লিনজিং’ অভিযান চালাচ্ছে না। তারা ‘কঠিন আচরণবিধি মেনে নিরাপত্তা অভিযান চালাচ্ছে’ এবং ‘নিরীহ বেসামরিক লোকজনের ক্ষতি না করার’ নীতি তারা নিপুণভাবে পালন করছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি তিনি আগের মতোই সহানুভূতিহীনই থাকলেন।
গত ২৫ আগস্ট ঘটনার শুরু। এত দিন পর তিনি ব্যাখ্যা দিলেন। যেন এত দিন তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুম ভেঙে দেখেন শিশুরা ঝগড়া করেছে। এবার তিনি দুই পক্ষের কথা শুনবেন এবং তারপর ব্যবস্থা নেবেন। সু চি এখন জানবেন কেন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে এল। তারপর তিনি যাচাই-বাছাই করে দেখবেন, কাদের কাদের ফেরত নেওয়া যায়। বলেছেন, ‘অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ আছে। আমাদের সবগুলোই শুনতে হবে। কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে অভিযোগগুলো নিরেট প্রমাণের ভিত্তিতে করা হয়েছে।’ এক পক্ষ রোহিঙ্গা, অন্য পক্ষ মিয়ানমারের কুখ্যাত সামরিক বাহিনী। সু চি এবং তাঁর সরকার কি তৃতীয় কোনো পক্ষ? তাঁর নিরপেক্ষতার এই ভান বুঝিয়ে দেয় কত বড় উভসংকটে তিনিও পড়েছেন। কার্যত সেনাবাহিনী তাঁর শত্রু হলেও দৃশ্যত সু চির ভূমিকা হয়েছে তাদের গণহত্যা ঢাকায় নিজের ভাবমূর্তি খরচ করতে থাকা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চিলক প্রধান জেমস গোমেজের ভাষায় ‘তিনি সেনাবাহিনীর ঢাল হয়েছেন’। গোমেজ বলেন, ‘৫ সেপ্টেম্বরের পর রাখাইন রাজ্যে কোনো (রোহিঙ্গাদের ওপর) আক্রমণ হয়নি বলছেন তিনি, তাহলে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী, কেন সেখানে এখনো আগুন জ্বলছে?’
সু চির ধাপ্পা স্পষ্ট হয় যখন তিনি রাখাইনে ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার’ কথা বলেন। যে আইনে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে, সেই আইনের শাসন? সেই আইন মানলে তো রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বই থাকে না! আর নাগরিকই যদি তারা না হয়, তাহলে যাচাই করে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসের মূল্য কতটা? নাকি এটা নিছক সময়ক্ষেপণের কৌশল? দ্বিতীয়ত, প্রায় চার দশকে যেভাবে হত্যা-বিতাড়ন-দমনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক ও দালিলিক প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। এরপর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ২০ লাখ রোহিঙ্গার কতজনকে ফেরত পাঠানোর বন্দোবস্ত করা সম্ভব হবে?
তারপরও সু চির এই যাচাইকরণের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার আশা তুলে ধরা এবং জাতিসংঘ তদন্ত দলকে রাখাইনে ‘বাধাহীন’ প্রবেশের প্রতিশ্রুতিকে একেবারে বাতিল করা যাবে না। চাপ দিয়ে অন্ধকারের দুর্গের এই চিকন ফাটলটি আরও চওড়া করার কাজ এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে। বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের কাছে যে প্রমাণাদি আছে, সেগুলোর ব্যবহারের এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কূটনীতি ও সংলাপের সরু করিডর খুলে আন্তর্জাতিক চাপ হালকা করার চেষ্টা করেছে বটে। তবে অন্যরাও সমস্যার গনগনে পাত্রটিতে হাত রাখার একটি কূটনৈতিক হাতল পেল। সু চি ছাড়া তো ওই দেশের আর কারও নৈতিক জাগরণের আশা বৃথা।
সু চির এই বক্তৃতার পাণ্ডুলিপি যারাই লিখে দিক, সেই পাণ্ডুলিপির পূর্বশর্ত হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে তথাকথিত ‘রোহিঙ্গা মুসলিম সন্ত্রাসবাদের’ জুজু। সু চি জানেন জর্জ বুশের ওয়ার অন টেরর পরবর্তী দুনিয়ায় ‘মুসলিম সন্ত্রাসবাদের’ কার্ড একেবারে বৃথা যায় না। মার্কিন পণ্ডিত স্যামুয়েল হান্টিংটনের ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্বের বিষ বিশ্বের সব সমাজেই চারিয়ে গেছে। এর মধ্যে আমরা আইএস নামধারীদের বর্বরতাও দেখেছি। ‘মুসলিম সন্ত্রাসবাদের’ ভয়ে দেখিয়ে নাবালক-সাবালক অনেককেই ঘুম পাড়িয়ে রাখা সম্ভব। সু চি সুকৌশলে সন্ত্রাসবিরোধী ওই স্পর্শকাতর তারটা বাজাতে চেয়েছেন। কূটচালে ওস্তাদ ইতালিয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মেকিয়াভেলির নামের অনুকরণে এক বন্ধুর ভাষায় এটা অং সান সু চির মেকিয়াভেলকি। চুরমার হয়ে যাওয়া ভাবমূর্তির গায়ে পলেস্তারা লাগানোর সুযোগ তিনি নিলেন।
বিশ্ব তাঁর কাছে বাণী চেয়েছিল, তিনি বাণী দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসের অভিযোগ’ তাঁর। প্রশ্ন হচ্ছে, আরসা নামের রহস্যময় গ্রুপটার নাম শোনা যাচ্ছে দুই বছর যাবৎ। গত বছরের অক্টোবর মাসেও তারা হামলা করেছিল বলে অভিযোগ। তাদের ঠেকানোর নামে পরের ছয় মাস রাখাইনে অভিযান চলে। আবার তাদের ঠেকানোর নামেই জুলাই মাস থেকে নতুন করে দুই ডিভিশন সেনা আসে রাখাইনে। চলে অভিযান। তাদের নিষিদ্ধ করার জন্য সময় নেওয়া হয় গত ২৫ আগস্টের হামলার পরদিন পর্যন্ত। কেন? সন্ত্রাস দমনের উসিলা হাতে রাখার জন্য কি? দুটি মাত্র ইউটিউব ভিডিও ছাড়া এই গ্রুপের অস্তিত্বের এবং রাখাইনে মিয়ানমারের সেনা-পুলিশ চৌকিতে হামলার প্রমাণই বা কী? অথচ এদের দমনের অজুহাত ব্যবহার করেই রোহিঙ্গাদের গণহত্যা এবং সমূলে বিতাড়ন ও বসতি ধ্বংস জায়েজ করা হলো। রোহিঙ্গাদের ট্র্যাজেডিকে ‘সিকিউরিটি’ সমস্যা হিসেবে চিত্রায়নের এই সুযোগ লুফে নিল মিয়ানমারের মধুলোভী আন্তর্জাতিক মিত্ররা। সু চির মতো তারাও রাখাইনে ‘নিরাপত্তা’ সমস্যা দেখছে, গণহত্যা দেখছে না!
সু চি এই ইংরেজি বক্তৃতার উদ্দেশ্য বিদেশি কূটনীতিক ও সাংবাদিক। এ বক্তব্যে শান্তিকামী রাষ্ট্রনেতার পরিচয় পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় তাঁর বর্তমান ও সত্যিকার পরিচয়। স্টেট কাউন্সেলরের পদাধিকারী হলেও তিনি মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর কণ্ঠ দিয়ে কথা বলেছে মিয়ানমারের আসল ক্ষমতা—সামরিক জান্তা। সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সেটাই কাজ। তিনি শুধু শান্তির প্রতীকের মর্যাদা থেকেই পতিত হননি, রাষ্ট্রনায়কোচিত অবস্থান নিতেও ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি রাখাইনে গণহত্যা ও জাতিগত নিধন চালানো সামরিক জান্তার তিল পরিমাণ সমালোচনা করেননি, বলেছেন সবই আইন ও বিধান মেনেই করা হচ্ছে।
দেশটির সাবেক এক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা উইন তেইন ঠিকই বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী তাঁর প্রতিটি শব্দ খেয়াল করছে। মুসলিম ইস্যুতে একটা ভুল পদক্ষেপ দেখলেই তারা পদক্ষেপ নেবে।’ (নিউইয়র্ক টাইমস, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭)। একসময়ের বিবেকের বন্দী এখন ক্ষমতার নন্দিনী ও বন্দিনীটি দুটিই। অহিংস নেত্রীর ভূমিকা এখন গণহত্যার সাফাই গাওয়া। তিনি তাঁর জাতির বিবেক নন আর, তিনি তাঁর দেশ দখলকারী সামরিক জান্তা এবং তাদের সঙ্গী বর্মি বর্ণবাদীদের পাবলিক রিলেশন অফিসার মাত্র। এই সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের অংশীদার তিনি নিজেও। অথচ রাখাইনের রোহিঙ্গারা বন্দী সু চির মুক্তি চেয়েছিল, তাঁকেই ভোট দিয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের মুসলিমরা সু চির দলের অনুসারী। আর দলটিও ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে।
এই রূপান্তর শুধু তাঁর নয়, তাঁর দলেরও। এ বছরের ২৯ জানুয়ারি হত্যা করা হয় মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান সংবিধান বিশেষজ্ঞ মুসলিম আইনজীবী উ কো নিকে। উ কো নি ছিলেন সু চির আইনি উপদেষ্টা। সেনাবাহিনী যখন নাগরিকত্ব আইনের ফ্যাকড়া বাঁধিয়ে নির্বাচনজয়ী সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়া ঠেকিয়ে দিল, তখন উপায় বের করেন কো নি। তিনি সেনাবাহিনীর তৈরি সংবিধানের ফাঁক বের করে স্টেট কাউন্সেলর পদ সৃষ্টির বুদ্ধি দেন। সু চি যে আজ সরকারে, তার পেছনে অবদান ছিল কো নির। এক মাস পর স্মরণসভায় সু চি এই হত্যাকাণ্ডকে ‘সন্ত্রাসী কাজ’ বলে নিন্দা করে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীকে শহীদ বলে আখ্যা দেন।
তদন্তে দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের পক্ষে সরব এই আইনজীবীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল এক সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। একইভাবে ১৯৪৬ সালে সুচির বাবার সঙ্গেও নিহত হয়েছিলেন তাঁর বন্ধু ও স্বাধীনতার অন্যতম নেতা আবদুর রাজ্জাক । তার আশি বছর পর সু চি এবং গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের জন্য জীবন দিলেন আরেক মুসলিম নেতা। নয় মাস আগে যে ঘাতকদের সু চি সন্ত্রাসী বলেছিলেন, এখন তিনি তাদেরই তোতাপাখি। বন্ধু শত্রু হয়েছে তাঁর, আর শত্রু হয়েছে বন্ধু। যে নাগরিকত্ব আইন তাঁকে প্রেসিডেন্ট হতে দেয়নি, সেই একই আইন রোহিঙ্গাদেরও রাষ্ট্রহীন করেছে; হত্যা কিংবা উচ্ছেদের মুখে ফেলেছে। অং সান সু চি সেই বর্ণবাদী আইনের পক্ষেই গেলেন। ইতিহাসের পরিহাস এমনই অদ্ভুত ও নিষ্ঠুর এবং এমনই দুর্ভাগ্য আমাদের, সু চিহীন মিয়ানমার আর স-সু চি মিয়ানমারের মধ্যে বাজি ধরতে হবে দ্বিতীয় পক্ষেই।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]