কঠিন বাঁকের মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি

আড়াই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির উন্নতির ধারা দেশটির মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর এবং নিকট ভবিষ্যতে অনুন্নত দেশের (এলডিসি) অবস্থা থেকে উত্তরণের বিষয়ে আশা জাগিয়ে তুলেছে। ১৯৯০ সালে পৃথিবীতে দেশগুলোর শীর্ষ অর্থনীতির আকারের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫০তম। সাফল্যের সঙ্গে ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ এই তালিকায় ৩১তম স্থানে চলে আসে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীতে ২৮তম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে।

বাংলাদেশের ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার কথা। সরকারি অন্যান্য দৃশ্যকল্প অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধির হার ৯-১০ শতাংশ হবে। এর পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আলোকে ২০৩০ সালের মধ্যে অনেক কঠিন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনের কর্মসূচি রয়েছে।

আড়াই দশক ধরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে নানাবিধ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উপাদান এবং তাদের মিথস্ক্রিয়ার
ভূমিকা রয়েছে। প্রধান অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে স্থিতিশীল সামগ্রিক অর্থনীতি, ব্যক্তি খাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শক্তিশালী অবস্থান, বড় আকারের রেমিট্যান্সের প্রবাহ, কৃষি খাতের অগ্রগতি, সাধারণভাবে স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা (যদিও বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ হয়েছে), সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সম্প্রসারণ এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচির বিস্তৃতি।

গুরুত্বপূর্ণ বাহ্যিক কারণের মধ্যে রয়েছে প্রধান রপ্তানি বাজারসমূহে অনুকূল প্রবেশাধিকার, প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোতে কমবেশি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে স্থিতিশীল রাজনৈতিক সম্পর্ক, যা বিভিন্ন মাত্রায় আঞ্চলিক এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের ‘দুর্বল’ আর্থিক সংযোগ, যা বাংলাদেশকে গত দশকের শেষ দিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট (গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস) থেকে রক্ষা করেছে।

বাংলাদেশে আড়াই দশক ধরে চলমান প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নপ্রক্রিয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক অবদান রেখেছে এবং অর্থনীতিতে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এখন মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি গতানুগতিক পথে সামনের দিনগুলোতে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের উপর্যুক্ত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জন করতে পারবে? উপরন্তু কঠিন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে শুধু অর্থনীতির আকারের তালিকার ওপরের দিকে ওঠা বাংলাদেশের জন্য কতটুকু অর্থ বহন করে? এই উদ্বেগের বাস্তবতা আছে। কারণ, বাংলাদেশ বর্তমানে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে সামগ্রিক অর্থনীতি ও রপ্তানি খাতের বৈচিত্র্যহীনতা, দুর্বল অবকাঠামো, অনুন্নত কর্মপরিবেশ, শ্রমের নিম্ন উৎপাদনশীলতা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, অতিমাত্রায় অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা, হতাশাজনক নিম্নমাত্রার কর-জিডিপির অনুপাত, মন্থর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ও ব্যবসা করার ক্ষেত্রে খুবই উচ্চ অদৃশ্য খরচ।

উপরন্তু বৈশ্বিক পর্যায়ে উদীয়মান ‘নব্য সংরক্ষণবাদের’ কারণে—যার উদাহরণ হচ্ছে ব্রেক্সিট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন—বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থার মধ্যে অনেক অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য সহায়ক নয়। সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্কে অবনতির যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, তা বাংলাদেশের সঙ্গে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।

প্রথমত, সামগ্রিক ও খাতভিত্তিক উভয় ক্ষেত্রেই অবকাঠামো নির্মাণে বড় আকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। নীতিনির্ধারকেরা সাধারণভাবে বড় আকারের অবকাঠামোর উন্নতির দিকে আগ্রহী থাকেন। এর বিপদ হচ্ছে যে অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ খাতভিত্তিক অবকাঠামোর উন্নয়ন উপেক্ষিত হয়। ফলস্বরূপ, অর্থনীতি ও রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের জন্য সহায়ক এ রকম গুরুত্বপূর্ণ অনেক সম্ভাব্য খাতই বড় আকারের অবকাঠামোগত উন্নতির সুবিধা নিতে ব্যর্থ হতে পারে। এটাও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, যদিও অবকাঠামোগত বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজন, মন্দ, অপরিকল্পিত ও বিলম্বিত অবকাঠামোগত বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগের জন্য নীতিমালা প্রণয়নপ্রক্রিয়ায় সাহসী ও বাস্তবধর্মী পরিবর্তন প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নতির ধারা কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রবৃদ্ধির ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। সরকারি হিসাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রবৃদ্ধির হার যথেষ্ট কম। এই অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ, এ রকম একটি ‘কর্মসংস্থান’বিমুখ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নানা রকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য বৃদ্ধি এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে সহায়ক। শ্রমবান্ধব প্রযুক্তিনির্ভর খাতসমূহে কীভাবে আরও বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা যায় এবং এ ধরনের বিনিয়োগের বাধাগুলো কীভাবে অপসারণ করা যায়, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, দেশের বর্তমান দুর্বল কর-জিডিপি অনুপাতকে (প্রায় ১০ শতাংশ) উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো প্রয়োজন। বিশ্বের সর্বনিম্ন কর–জিডিপি অনুপাতের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ (যারা কর দিতে সক্ষম) এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমের একটি বৃহৎ অংশ কর আওতার বাইরে। এ ছাড়া দেশের বৃহৎ অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি এবং কর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাবের মতো কাঠামোগত কারণগুলোও কর সংগ্রহে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়।

যদিও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ কর কাঠামোতে কিছু কিছু সংস্কার করেছে। কিন্তু বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও কায়েমি স্বার্থের পক্ষে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এসব সংস্কারের সাফল্য কম। সম্প্রতি মূল্য সংযোজন কর-সংক্রান্ত নতুন আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এর একটি বড় উদাহরণ। অতএব, রাজস্ব নীতিতে কিছু সাহসী পদক্ষেপ এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন, যা কর–ব্যবস্থাকে সরলীকরণ করবে, কর প্রশাসনকে শক্তিশালী করবে এবং কর-ভিত্তির বড় ধরনের সম্প্রসারণ ঘটাবে। এসব কিছুই দেশের সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি এবং আনুষ্ঠানিক খাতের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বৃহত্তর সংস্কার কর্মসূচির আওতাধীন হওয়া উচিত।

চতুর্থত, মুদ্রানীতিতেও সাহসী পরিবর্তন প্রয়োজন। যদিও কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি সাধারণভাবে অর্থনীতিতে তথাকথিত স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করার জন্য তা বড় ধরনের উদ্যম সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে সম্প্রতি ঋণ কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণের বড় উত্থান আর্থিক খাতের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার চিত্রকে প্রকট করেছে। উপরন্তু শুধু সুদের হার কমানো বেসরকারি খাতের ঋণ সম্প্রসারণের জন্য যথেষ্ট নয়। বেসরকারি খাত ব্যবসার পরিবেশবিষয়ক অন্যান্য অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং ওপরে বর্ণিত বৃহত্তর সংস্কার কর্মসূচির আওতায় এসবের সমাধান করা প্রয়োজন।

পঞ্চমত, দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ, বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগ, আকৃষ্ট করতে দৃশ্যমান ‘সাফল্য’ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দুর্বল অবকাঠামো, প্রতিকূল ব্যবসা পরিবেশ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ঝুঁকি বাংলাদেশে দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে কাজ করে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) খুব শিগগির নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে এই প্রকল্পগুলোর সময়মতো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উজ্জ্বল সম্ভাবনা বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ের কাছ থেকে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক নীতির ধারাবাহিকতা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সাফল্য নিশ্চিত করতে পারে।

ষষ্ঠত, বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশের জন্য দক্ষিণ-দক্ষিণ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা-বিষয়ক অ্যাজেন্ডা আরও বেশি মাত্রায় অনুসরণ করা দরকার। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মানসিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে দেশটি এ ধরনের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার আলোচনার ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রায়োগিক সমাধান করার জন্য বাংলাদেশকে সক্রিয়ভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কূটনীতি প্রয়োগে আরও কুশলতা অর্জন করতে হবে।

২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধীনে সামাজিক ও পরিবেশগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন প্রয়োজন, যেহেতু গতানুগতিক প্রক্রিয়া কোনোভাবেই বাংলাদেশকে এসব লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে না। বোঝা উচিত, কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধীনে সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত নয়। কার্যকর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি এবং কর্মসূচির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উন্নতি প্রয়োজন, যা এখন আগের চেয়ে আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।

ড. সেলিম রায়হান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক।