প্রতিবাদটা চালিয়ে যেতে হবে

বরগুনার বেতাগী উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষিকা একদিন স্কুল ছুটির পর পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। সে সময় স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর স্বামী। তিনি স্ত্রীকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন। এ সময় এলাকার ছয়-সাতজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী স্কুলের ফটকে জড়ো হয় এবং স্কুলের ভেতরে ঢুকতে চায়। তখন ওই শিক্ষিকা তাদের ঢুকতে না দিয়ে ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। এতে করে ওই সন্ত্রাসীরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। তারা তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে শিক্ষিকার স্বামীকে এলোপাতাড়ি মারধর করে তাঁর পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় জানার পর তারা শিক্ষিকার স্বামীকে স্কুলের একটি কক্ষে আটকে রাখে। আর শিক্ষিকাকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে একে একে সব যুবক ধর্ষণ করে।

একটি বিদ্যালয়ে ঢুকে সন্ত্রাসী-বখাটেরা এক শিক্ষককে ধর্ষণ করেছে, তাঁর স্বামীকে মারধর করে পাশের কক্ষে আটকে রেখেছে, এর চেয়ে বর্বরতা আর কী হতে পারে?

গত আগস্ট মাসে বর্বরোচিত এ ঘটনার পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওই শিক্ষিকার সহকর্মীরা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেন। সেখানে তাঁরা কালো ব্যাজ ধারণ ও মানববন্ধন করেছেন। শিক্ষা অফিসে স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু এর বাইরে স্থানীয়ভাবে বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ হয়নি। এ বড় হতাশাজনক। তাহলে কি আমরা দিনে দিনে বোধশূন্য হয়ে পড়ছি? শিক্ষিকা ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ করার দায়িত্ব কি কেবল শিক্ষকদেরই? সমাজের অন্যান্য শ্রেণি ও পেশার মানুষের কোনো দায় নেই? নাকি আমরা সবাই বুঝে গেছি যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করে আসলে কোনো লাভ নেই।

এ ধর্ষণের ঘটনায় থানায় মামলা করলে পুলিশ মামলা নিয়েছে বটে; তবে ঘটনার পর এক মাস পার হলেও আসামিদের সবাই এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে, দুর্বৃত্তরা গা-ঢাকা দিয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রথমে ধর্ষণের আলামত পাওয়ার কথা বলা হলেও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক এক দিন পরই বলেন, ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ব্যস, এই পর্যন্তই। এরপর আর কোনো খবর নেই। সম্ভবত আর কোনো খবর হবেও না। তর্কের খাতিরে বলতে পারি, ব্যাপক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়নি বলে এই ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।

কিন্তু যেসব ঘটনায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে, লেখালেখি হয়েছে, সেসব ঘটনার পরিণতিও তো একই রকম। যেমন গত জুলাই মাসে বগুড়ায় এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ ও তার মাকে নির্যাতনের ঘটনায় গোটা দেশ তোলপাড় হয়। পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু এখন আর এ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। সেই ধর্ষক তুফান সরকার জেলে। আর ধর্ষণের শিকার ওই মেয়ে ও তার মা রাজশাহীতে সেফ হোমে। কিন্তু ধর্ষণ মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। এখানেও ঘটনা এ পর্যন্তই।

রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী ধর্ষণের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় দায়ের করা মামলারও কোনো অগ্রগতি নেই। তনু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় তো গোটা দেশ তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ধর্ষণ ও হত্যা মামলার কোনো খবরই আজ আমরা জানতে পারছি না। কেন এমনটা হচ্ছে? প্রশ্নটা কঠিন নয়, উত্তরও জানা। প্রশাসনিক শিথিলতা, আসামী পক্ষের কলকাঠি নাড়ানো এবং আমাদের উদাসীনতা।

বলা হয়, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য বোধ হয় কথাটি ঠিক নয়। আইন এখানে চলে প্রভাবশালীদের ইচ্ছায়। কারণ, প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যেসব ধর্ষক রাজনৈতিকভাবে বা আর্থিকভাবে প্রভাবশালী বা এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, তারা ধর্ষণের ঘটনার পর প্রভাব খাটানো শুরু করে। অর্থের বিনিময়ে তারা থানা, আদালত ও চিকিৎসকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে অথবা ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারকে ভয়ভীতি দেখানো শুরু করে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য। এ কারণে ধর্ষকদের বিচার হতে আর দেখি না। ধর্ষকেরা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর আমরা কিছুই করতে পারি না।

যেহেতু এ দেশে আইন সবার জন্য সমান নয়, সেহেতু প্রতিবাদ-বিক্ষোভই আমাদের ভরসা। প্রতিবাদ করে লাভ নেই—এমনটা ভাবলে হবে না। আসলে আমাদের প্রতিবাদটা চালিয়ে যেতে হবে ধর্ষকের বিচার না হওয়া পর্যন্ত। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা না হলে এই সন্ত্রাসীরা ক্রমাগত উৎসাহিত হবে এবং একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতেই থাকবে। আসুন, আমরা সবাই সোচ্চার হই ধর্ষণের বিরুদ্ধে। সব রকমের অন্যায়ের বিরুদ্ধে; হোক সে অন্যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপরে। তা না হলে তো আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করতে পারব না। আমরা চাই, বরগুনার ওই শিক্ষিকা ধর্ষণসহ সব ধর্ষণের ঘটনার বিচার হোক। উপযুক্ত সাজা পাক ধর্ষকেরা।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক