এই নগর কি পরিচ্ছন্ন হবে না?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘ঢাকায় ২৪০ কোটি টাকার ময়লা-বাণিজ্য’। অনুসন্ধানীমূলক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ নিয়ে প্রতি মাসে অন্তত ২০ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। বছরে এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪০ কোটি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ময়লা সংগ্রহ করা হয় এবং সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ফির চেয়ে অনেক বেশি টাকা দিতে হয় করপোরেশনের বাসিন্দাদের। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের লোকজন, আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী বা তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা এই ময়লা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাঝেমধ্যেই রাজনৈতিক রেষারেষি, হাঙ্গামা হয়। প্রতিবেদনের মোদ্দা কথা হচ্ছে রাজধানীতে ময়লা সংগ্রহ এখন বিরাট লাভজনক ব্যবসা। করপোরেশনের বাসিন্দাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কারণে এই ব্যবসা করে অনেকে ফুলেফেঁপে উঠেছেন।

প্রতিবেদনটি পড়ে রাজধানীতে বাসাবাড়ির ময়লা সংগ্রহের প্রক্রিয়াসহ অনেক খুঁটিনাটি জানা গেল। জানতে পারলাম বাসাবাড়ির ময়লা সংগ্রহের শুরুর কথা। এ উদ্যোগ শুরু হয়েছিল আশির দশকে মহল্লার সামাজিক কাজ হিসেবে। পথটা দেখিয়েছিলেন কলাবাগানের কয়েকজন বাসিন্দা। তখন বাসাপ্রতি খরচ হিসেবে কিছু টাকা নেওয়া হতো। আমি কলাবাগান এলাকার ওই বাসিন্দাদের ধন্যবাদ দিতে চাই। তাঁরা এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলেই না আজ আমরা এত সহজে ও আরামে বাড়ির ময়লা দূর করতে পারছি। যখন এই ব্যবস্থা চালু ছিল না, তখনকার কথা ভাবুন। ময়লা ফেলে দিয়ে আসতে হতো রাস্তার পাশের খোলা ডাস্টবিনে। বাড়ির কাজের মানুষেরা সাধারণত এই দায়িত্বটা পালন করত। আর কাজের লোক না থাকলে বাড়ির সদস্যদের কাউকে না কাউকে এই কাজটি করতে হতো। দুর্গন্ধে ডাস্টবিনের কাছে যাওয়া যেত না। কেউ কেউ ময়লা ডাস্টবিনের ভেতরে না ফেলে বাইরে ফেলত। ফলে ডাস্টবিনের আশপাশের একটা বড় অংশ ময়লায় পরিপূর্ণ থাকত। এখনো থাকে। প্রথমে যখন এভাবে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করা শুরু হয়, তখন ময়লা সংগ্রহকারীকে দিতে হতো ১০ টাকা। ২০০৯ সালে সিটি করপোরেশন ৩০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দেয়। তবে সিটি করপোরেশন এই টাকার কোনো ভাগ পায় না। সেই ফি এখন ১০০ থেকে ১২০ টাকায় ঠেকেছে। অভিজাত এলাকাগুলোতে এই ফি আরও বেশি। ভবিষ্যতে হয়তো আরও বাড়বে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।  বেসরকারিভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান ময়লা সংগ্রহ করে তাদের একটি সংগঠনও রয়েছে; নাম প্রাইমারি ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিস প্রোভাইডারস (পিডব্লিউসিএসপি)। এটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহযোগী সংগঠন হিসেবে সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত। সংগঠনটি ইতিমধ্যে ময়লা নেওয়ার জন্য ফি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে অনেকেই হয়তো বড়লোক হচ্ছেন। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সিটি করপোরেশন শুধু নির্ধারিত জায়গায় রাখা ময়লার কনটেইনার এবং ময়লা রাখার ঘর বা সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থেকে ময়লা সংগ্রহ করে।

জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষামতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন বর্জ্য জমা হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে গৃহস্থালি ও দোকান থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টন ময়লা তৈরি হয়। ঢাকায় এখন দুটি সিটি করপোরেশন। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এই দুই করপোরেশন খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বাসাবাড়ির ময়লা দূর হলেও রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই করুণ। রাজধানীর খুব কম এলাকা আছে, যেখান থেকে নিয়মিত ময়লা অপসারণ করা হয়।

সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের খুব কমই রাস্তার ময়লা ঝাড়ু দেওয়ার কাজটি ঠিকভাবে করেন। অভিজাত হিসেবে পরিচিত নয় এমন সব এলাকার অবস্থা খুবই নাজুক। সড়কের আশপাশে ময়লা পড়ে থাকে দিনের পর দিন। পরিষ্কার
করার নামটি কেউ করে না। একসময় এসব ময়লা মাটির সঙ্গে মিশে যায় কিংবা ড্রেনে পড়ে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে।

দিন কয়েক আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে দেখলাম, সিটি করপোরেশনের যেসব ট্রাক বর্জ্য বহন করে ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে যায়, সেগুলোর বেশির ভাগের ত্রিপল নেই। ত্রিপল না থাকায় বর্জ্য নিয়ে গন্তব্যে যাওয়ার সময় দুর্গন্ধের পাশাপাশি ট্রাক থেকে বর্জ্য ও ময়লা পানি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ময়লা আর পরিষ্কার হয় না। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এসব বর্জ্যের কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণু ছড়াচ্ছে। কী ভয়াবহ ব্যাপার!

এভাবেই চলছে। এই নোংরার মধ্যেই বসবাস রাজধানীবাসীর। মেয়র আসে মেয়র যায়। নোংরা শহর নোংরাই থেকে যায়। প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ঢাকা মহানগরীকে তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত করা থেকে সবুজ ঢাকা, বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন মেয়রপ্রার্থীরা। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয় না কখনোই। এ রকমই কি চলবে? আমাদের এই প্রিয় শহরটা কি কখনো পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে গড়ে উঠবে না? বিশ্বের অন্যান্য নগরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হলে আমাদের এখানে বাধা কোথায়? কেন সিটি করপোরেশন আমাদের এই ঢাকা নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারছে না? তাদের কি আসলেই কিছু করার নেই?

 সিটি করপোরেশন সব সময় শহর পরিচ্ছন্ন না হওয়ার জন্য স্বল্প বাজেট ও জনবলের অভাবকে দায়ী করে থাকে। তাই যদি হবে তাহলে প্রথমে করণীয় হচ্ছে বাজেট ও লোকবল বাড়ানো। আর সেটা করা যদি সম্ভব না হয় তাহলে বেসরকারিভাবে বাসাবাড়ি থেকে যেভাবে টাকার বিনিময়ে ময়লা সংগ্রহ করা হচ্ছে, একইভাবে রাস্তাঘাট, অলিগলি পরিষ্কারের কাজটিও বেসরকারিভাবে করা যেতে পারে। ন্যায্য ও যুক্তিসংগত ফির বিনিময়ে এটা করা যেতেই পারে। শহরটা তো অন্তত পরিষ্কার থাকবে। তবে এই রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার অছিলায় যাতে আবার কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য না হয়, সেটাও দেখতে হবে।

তবে নগর অপরিচ্ছন্ন থাকার সব দায় সিটি করপোরেশনগুলোর ওপর না দিয়ে নিজেদের দিকেও তাকাতে হবে। আমরা নগরবাসী সবাই কি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকি? এই নগরটা এত নোংরা হয় সে আমরা করি বলে। আমাদের অনেকের স্বভাব হচ্ছে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা। আইসক্রিম খেয়ে বা চিপস খেয়ে প্যাকেটটা আমরা অনেকে রাস্তাতেই ফেলি। কটা টাকা বাঁচানোর জন্য বাসার বর্জ্য ময়লা সংগ্রহকারীদের কাছে না দিয়ে রাস্তার মোড়ে ফেলছি। আমাদের এসব বাজে স্বভাবের বদল না হলে শহর নোংরাই থাকবে। উন্নত দেশগুলোতে বাসাবাড়ি বা রাস্তাঘাট নোংরা করলে মোটা অঙ্কের অর্থ জরিমানা করা হয়। আমাদের দেশেও সে রকম জরিমানার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তবেই যদি স্বভাব বদলায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সংগৃহীত বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও জৈব সার উৎপাদন করা সম্ভব। পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ, রাজধানীর আবর্জনাকে সম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এরই মধ্যে দুটি ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরির কাজ শুরু করেছে অধিদপ্তর। এই দুটি প্ল্যান্টের মাধ্যমে নগরীর সব বর্জ্যকে সারে রূপান্তরিত করা হবে।

এসব খবর একটু হলেও মনে আশা জাগায়। হয়তো শিগগিরই আমরা পেয়ে যাব পরিচ্ছন্ন ঢাকা নগরী। যাহোক, রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ওপরের যেকোনো একটি উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক।