মহররম ও আশুরার তাৎপর্য

মহররম, আশুরা ও কারবালা—এ তিনটি শব্দ যেন একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে একটি যৌগ দর্শন সৃষ্টি করেছে। মহররম পবিত্রতা, মর্যাদা, সম্মান ও সুনাম-সুখ্যাতির প্রতীক। আশুরা পূর্ণতাপ্রাপ্তি ও সফলতার প্রতীক; কারবালা বিপদাপদ, বালামুসিবত ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রতীক।  মহররম ও আশুরার শিক্ষা ও তাৎপর্যকে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত চিরভাস্বর করে রাখবে কারবালার শহীদদের অবদান।

কিছু শব্দ জোড়া বা শব্দগুচ্ছ থাকে, যেগুলোর একটি ছাড়া অন্যটির ব্যবহার সম্ভবপর হয় না, একটি ছাড়া অপরটির ব্যবহার পূর্ণতা পায় না এবং একক একটির প্রয়োগে ভাবের ও অর্থের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে না। এসব শব্দগুচ্ছ হলো ‘মহররম, আশুরা ও কারবালা’। তাই আশুরা ছাড়া মহররম যেমন দ্যুতিহীন, তেমনি কারবালা ছাড়া আশুরাও আজ তাত্পর্যহীন।

 প্রিয় নবীজি (সা.)–এর প্রিয় দৌহিত্র, হজরত আলীর (রা.) পুত্র, হজরত বিবি ফাতেমা (রা.)–এর তনয় হজরত হোসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন মহররম ও আশুরার প্রকৃত তাৎপর্য। সঙ্গে পরিবারের সদস্যসহ বাহাত্তর জন সঙ্গীর আত্মত্যাগ শিখিয়ে গেল সত্যের প্রতি অবিচল আনুগত্য ও অনুরাগের পরাকাষ্ঠা। শিশু আলী আসগরের শাহাদত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মহান আল্লাহর বাণী, ‘বল, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা করো আর তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাসো; তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্য/ত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎ পথ প্রদর্শন করেন না।’ (আল–কোরআন, সুরা ৯ [১১৩] তাওবা-বারাআত, মাদানি, রুকু: ৩/৯, আয়াত: ২৪, মঞ্জিল: ২, পারা: ১০)। এই একটি আয়াত যেন আমাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট করে দেয় এবং জানিয়ে দেয় মানবজীবনে লক্ষ্য অর্জনের পথের সব বাধার কথা। এরই সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ মহানবী (সা.)-এর বাণী: দুনিয়ার মোহ সকল পাপের মূল। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)। একদিকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও তাঁর প্রিয়
হাবিব মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ভালোবাসা ও আনুগত্য। অপরদিকে দুনিয়ার মোহ; পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, ভ্রাতা-ভগ্নি, পতি-পত্নী, স্বজন-গোষ্ঠী, অর্জিত-সঞ্চিত সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়ি-ঘর, স্বদেশ-বাসস্থান এসবের মায়া।

হজরত হোসাইন (রা.) দেখিয়ে দিয়ে গেলেন দুনিয়ার সব আকর্ষণ পদদলিত করে সব মায়াজাল ছিন্ন করে কীভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে ও তাঁর প্রিয় নবীকে (সা.) খুশি করতে হয়। হজরত হোসাইন (রা.)–কে জালিম শাহির পক্ষ থেকে সেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ,যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল মদিনা হিজরতের আগে মক্কায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে। ‘টাকাপয়সা, অর্থসম্পদের পাহাড় দেব, সুন্দরী অতি সুন্দরী রমণী দেব, ক্ষমতার ভাগ দেব; তবু আমাদের অপকর্মের বিরোধিতা কোরো না।’ তখন মহান আল্লাহ তাআলা সুরা কাফিরুন নাজিল করেন। ‘(হে প্রিয় নবী) আপনি বলুন, হে অকৃতজ্ঞরা! আমি সেসবের পূজা করি না, যেসবের পূজা তোমরা করো। আর তোমরা (এমতাবস্থায়) ইবাদতকারী নও, আমি যার ইবাদত করি। আর আমি সেসবের পূজারি নই, যেসবের পূজা তোমরা করো। তোমাদের জন্য তোমাদের কর্মফল, আমার জন্য আমার কর্মফল। (আল কোরআন, সুরা-১০৯ [১৮] কাফিরুন, মাক্কি, রুকু: ১/৩৪, আয়াত: ১-৬, মঞ্জিল: ৭, পারা: ৩০)। এই সুরা কাফিরুন নাজিল হওয়ার পর বিশ্বনবী রহমাতুল্লিল আলামিন বলেন, শুধু এই নশ্বর দুনিয়ার সব ধনসম্পদ ও নাজ নেয়ামত নয়, যদি আমার এক হাতে চন্দ্র আরেক হাতে সূর্যও এনে দেওয়া হয়; তবু আমি সত্য প্রকাশে ও অন্যায়ে প্রতিরোধে বিরত হব না। (তাফসিরে ইবনে কাসির, সিরাতে ইবনে হিশাম, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। হজরত হোসাইন (রা.)–কেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনিও তাঁর প্রিয় নানা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই অনুপম আদর্শ অনুসরণ করলেন। দুনিয়ার তুচ্ছ ধনসম্পদ ও ভোগ-বিলাস পায়ে মাড়িয়ে, তিলে তিলে জীবন দিলেন, শাহাদত বরণ করলেন; কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করলেন না।

সমাজে ভালো মানুষ সব সময়ই কিছু না কিছু সংখ্যক থাকে। এই ভালো মানুষেরা যদি অন্যায়ের প্রতিবাদে সুদৃঢ় ও অবিচল থাকে তাহলে অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তখনই অন্যায় প্রতিষ্ঠা পায় যখন ভালো মানুষেরা অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়ে মৌনতা অবলম্বন করে। এসব মৌনব্রত পালনকারী ভালো মানুষের ব্যাপারে হাদিস শরিফে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেন, ‘সত্য বিষয় প্রকাশে নীরবতা পালনকারী বোবা শয়তান।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। অন্য হাদিসে রয়েছে মহানবী (সা.) বলেন, ‘জালিম শাসকের সম্মুখে হক কথা বলা উত্তম জিহাদ।’ (বুখারি ও তিরমিজি)।

সর্বকালেই ঘুণে ধরা অবক্ষয় ঘেরা অধঃপতিত সমাজের পরিবর্তনের জন্য ভালো মানুষদের নির্লোভ, নির্মোহ ও নির্ভয় নির্ভীক হতে হয়। বেরিয়ে আসতে হয় ‘বোবা শয়তান’-এর কাতার থেকে; শামিল হতে হয় হক কথার উত্তম জিহাদে। তবেই আসবে কাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক পরিবর্তন। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে জালিমের অন্যায় অপরাধ ও অপকর্মের দাস্তান; যেমন হয়েছিল কারবালার খলনায়কদের পরিণতি। মহান আল্লাহ তাআলার বাণী: মহাকালের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস করে, সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়। (আল–কোরআন, সুরা-১০৩ [১৩] আসর, মাক্কি, রুকু: ১/২৮, আয়াত: ১-৩, মঞ্জিল: ৭, পারা: ৩০)।

হজরত হোসাইন (রা.)-এর ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে আত্মদান মূলত অসত্য, অসুন্দর, অন্যায় ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের অনন্তকালের জন্য আদর্শিক বিজয়। হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত প্রকৃতপক্ষে ইয়াজিদেরই মৃত্যু ছিল।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।