পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছেন সৌদি নারীরা

বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের বিশ্ব নারী-পুরুষ বৈষম্য ২০১৬ শীর্ষক প্রতিবেদনে সৌদি আরবের অবস্থান ছিল ১৪৪টি দেশের মধ্যে ১৪১। আর ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে ছিল আরও এগিয়ে, ১৪৫টি দেশের মধ্যে ১৩৪। এর অর্থ এই নয় যে সৌদি নারীদের অবস্থা খারাপ হয়েছে। বরং সূচকের নিচে থাকা কয়েকটি দেশে নারীর অবস্থান সংহত হয়েছে। ২০১৫ সালের প্রতিবেদন মতে, ২০১৮-২০২২ সালের মধ্যে সৌদি আরবে ১৩ শতাংশ নারীকে কাজে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। 

অতীতে সৌদি নারীরা বলতে গেলে সব ধরনের মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তাঁদের ভোটাধিকার ছিল না, তাঁরা ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারতেন না। কিন্তু ২০১১ সালে বাদশাহ আবদুল্লাহ স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করেন। এমনকি তাঁরা পরামর্শ কমিটি কিংবা মজলিশে শুরার সদস্য নির্বাচিত হন। সৌদি নারীর শিক্ষার দরজাও প্রশস্ত হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছেলে শিক্ষার্থীর চেয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। ২০১৮-২০২২ সাল পর্যন্ত সৌদি নারীর সাক্ষরতার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৯১ শতাংশ। চল্লিশ বছর আগের সঙ্গে তুলনা করলে এই হার অনেক বেশি। তবে উচ্চশিক্ষায় মেয়েরা এগিয়ে থাকলেও সাক্ষরতার হারে তাঁরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে আছেন।
২০১৭ সালটি সৌদি নারীর জন্য খুবই আনন্দের বছর। এ বছর বাদশাহ সালমান ঘোষণা দিয়েছেন যে এখান থেকে নারীদের বাইরে কাজ করতে পুরুষের অনুমতি নিতে হবে না। বিশেষ করে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে কাজ করতে পারবেন। একই সঙ্গে সেখানে নারীরা ফতোয়া জারি করতে পারবেন। নারীদের ফতোয়া জারির বিষয়টি শুরা কাউন্সিলে বিপুল ভোটে পাস হয়েছে। এর পক্ষে ১০৭টি ভোট পড়ে। এর আগে ফতোয়া জারির বিষয়টি কেবল পুরুষদের জন্য নির্ধারিত ছিল। সৌদি আরবে রাজকীয় নির্দেশ বলে নারী মুফতি নিয়োগ করা হবে।
শুরা কাউন্সিলের নারী সদস্যরা গত মার্চে দাবি করেন, ফতোয়া জারির বিষয়টি কেবল পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা উচিত নয়। পরে কাউন্সিলের ৪৯তম বৈঠক এ-সংক্রান্ত সুপারিশ করেন এক সদস্য। জেনারেল প্রেসিডেন্সি অব স্কলারলি রিসার্চ অ্যান্ড ইফতা সৌদি আরবে ফতোয়া জারির জন্য একমাত্র অনুমোদিত সরকারি সংস্থা। শুরা কাউন্সিল এই সংস্থাকে আহ্বান জানিয়েছে নারীদের জন্য স্বাধীন শাখা খোলার জন্য।
তবে এখানেই সৌদি নারীর জয়যাত্রা থেমে নেই। মাত্র কয়েক দিন আগে বাদশাহ সালমান আরেক রাজকীয় ঘোষণায় জানিয়েছেন, নারীদের গাড়ি চালনায়ও কোনো বাধা নেই। সৌদি নারীরা বেশ কিছু বছর ধরেই গাড়ি চালনার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। বিনা অনুমতিতে গাড়ি চালিয়ে কেউ কেউ কারাদণ্ডও ভোগ করেছেন। এখন থেকে সেই সমস্যা আর থাকছে না।
যে দেশে নিকটাত্মীয় পুরুষকে সঙ্গে না নিয়ে নারী ঘরের বাইরে যেতে পারেন না, সে দেশে নারীর ফতোয়া দেওয়া বা গাড়ি চালনার অধিকার বিপ্লবই বলতে হবে।
ইতিমধ্যে ১ হাজার ৪৭০ জন সৌদি নারী জর্ডানে গাড়ি চালনার লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র নিয়েছেন। উল্লেখ্য, জর্ডানে দুই হাজারের বেশি সৌদি ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা গাড়ি চালনার অনুমতি নিয়েছেন, এখন থেকে তাঁরা গাড়ি চালিয়ে নিজের দেশে যেতে পারবেন। জর্ডানে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ুয়া ফাতিমা আল আওয়ামি সৌদি বাদশাহর এ ঘোষণায় শুকরিয়া জানিয়ে বলেছেন, এ সিদ্ধান্তটি ঐতিহাসিক এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখবে। হানান মোহাম্মদ নামে আরেক সৌদি ছাত্রী বলেছেন, তাঁর স্বামী জর্ডানে গাড়ি নিয়ে কবে ঢুকবেন সেই অপেক্ষায় আছেন। তিনি এলেই হানান গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখবেন।
কেবল ফাতিমা ও হানানের মতো শতসহস্র সৌদি নারী নিজ হাতে গাড়ি চালানোর অপেক্ষায় আছেন। তাঁদের মতে, এটি সত্যিই সৌদি নারীদের জীবনে বিপ্লব ঘটাবে। এত দিন তাঁদের কাজের সুযোগ থাকলেও একা বের হতে পারতেন না। পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে কর্মস্থলে যেতে হতো। এখন নিজেরা গাড়ি চালিয়ে কর্মস্থলে যেতে পারবেন। আর্থিকভাবেও তাঁরা স্বাবলম্বী হবেন।
সৌদি নারীরা বিয়েতে এত দিন তিনটি অধিকার পেতেন তাঁদের স্বামীদের কাছ থেকে। নিজের বাড়ি, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ। এখন থেকে আরেকটি অধিকার যুক্ত হলো পুরুষ সঙ্গীদের ছাড়াই তাঁরা গাড়ি চালাতে পারবেন। ঘটনাটি এতই নাটকীয় যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন। জেদ্দা থেকে নারীদের গাড়ি চালনার পক্ষে আন্দোলনকারীদের একজন শাহর নাফিস বলেছেন, ‘আমি খুবই উদ্বেলিত, আনন্দে নাচছি এবং প্রাণ খুলে হাসছি।’
উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবই একমাত্র দেশ, যেখানে নারীর গাড়ি চালনার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। বাদশাহ সালমানের ঘোষণায় সৌদি আরবের বেশির ভাগ মানুষ খুশি হলেও অখুশি হওয়ার লোকও আছে। নারী গাড়িচালকদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে সৌদি পুলিশ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছেন। ওই ব্যক্তি অনলাইন ভিডিওতে ঘোষণা দেন, ‘কোনো নারী রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হলেই আমি তাঁকে পুড়িয়ে মারব ও গাড়িও পুড়িয়ে দেব।’
সব দেশেই এ ধরনের ধর্মান্ধ মানুষ থাকে। ওহাবি মতবাদে দীক্ষিত সৌদি সমাজে এ হারটি হয়তো বেশি। কিন্তু এসব সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা ডিঙিয়েও সৌদি নারীরা পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছেন।
সৌদি নারীদের গাড়ি চালনার ঘোষণা এলেও তা কার্যকর হবে আগামী বছর জুন মাসে। তাই ভবিষ্যতে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখা সৌদি নারীদের জন্য আগাম অভিবাদন।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।