সহমর্মিতা নয়, প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনার

গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আট বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে। সেখানে সংস্থাটির মহাসচিব রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে ‘পৃথিবীর দ্রুততম অবনতিশীল জরুরি শরণার্থী সমস্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে একে ‘মানবতা ও মানবাধিকারের জন্য একটি দুঃস্বপ্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। একই সঙ্গে মহাসচিব শরণার্থীদের দেখভাল করার জন্য বাংলাদেশের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করতে গিয়ে বাংলাদেশ এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমন তাদের নিরাপত্তা বিধান ও পরিচর্যার জন্য বিশাল ধরনের কর্মযজ্ঞের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ঘনবসতি, সম্পদের স্বল্পতা, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে দারিদ্র্যের মাত্রা ও পরিকাঠামোগত স্বল্পতা এবং একই সঙ্গে শরণার্থী মোকাবিলার প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অনুপস্থিতি বিষয়টিকে আরও জটিল করেছে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের উচ্চতম পর্যায় থেকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে বেশ কিছু সেক্টর চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই চাপ মোকাবিলায় দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, যার সাড়া ইতিমধ্যে মিলছে।

রোহিঙ্গা সমস্যার সুদূরপ্রসারী সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে, একই সময়ে ৯-১০ লাখ শরণার্থীর জন্য ত্রাণ এবং সুরক্ষা প্রদান করার গুরুদায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর বর্তেছে। অদূর ভবিষ্যতে নিজ দেশে এই শরণার্থীদের মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই পরিস্থিতিতে এই সম্ভাব্য প্রলম্বিত শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। সে ক্ষেত্রে শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের যথেষ্ট বিচক্ষণতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। মানবিকতার সঙ্গে প্রয়োজন বিরাজমান বাস্তবতার সঠিক মূল্যায়ন। এ ক্ষেত্রে জরুরি হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আমরা কীভাবে আখ্যায়িত করছি, তা নির্দিষ্ট করা এবং সরকারের উদ্যোগকে যথাযথভাবে প্রতিপূরণ (সাপ্লিমেন্ট) করতে পারে, এমন সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া যার শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলায় অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এখনো এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে।

১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থীসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই দলিলে ১(ক) ধারায় শরণার্থীর সংজ্ঞা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শরণার্থী ‘এমন একজন ব্যক্তি যিনি নৃগোষ্ঠী, ধর্ম, লিঙ্গ, জাতীয়তা বা জাতিতাত্ত্বিক পরিচয়ের কারণে...নিগৃহীত হওয়ার দৃঢ়ভিত্তিক ভয়ের কারণে তার উৎস রাষ্ট্রের বাইরে অবস্থান করছেন এবং সে দেশ কর্তৃক প্রদত্ত রক্ষণাবেক্ষণ সুযোগ গ্রহণে অপারগ বা ওইরূপ ভয়ের কারণে অনিচ্ছুক।’ সুতরাং সনদের মাপকাঠিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত সব রোহিঙ্গা (যারা নথিভুক্ত হয়ে ক্যাম্পে এবং ক্যাম্পের বাইরে অবস্থান করছে এবং যারা ২৫ আগস্টের আগে ও পরবর্তী সময়ে এসেছে) এই সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার মাপকাঠিতে শরণার্থী।

গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী’দের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্যদের তিনি অবহিত করেন যে তিনি নিজে ১৯৭১ সালে একজন শরণার্থী ছিলেন এবং সে কারণে তিনি তাদের বেদনা অনুভব করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য সত্ত্বেও সরকারিভাবে শরণার্থীদের ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘মিয়ানমার থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী’, অথবা ‘মিয়ানমারের স্থানচ্যুত নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যা মন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ের ব্যক্তিদের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সাহায্যের জন্য সরকার জনগণের কাছে যে আবেদন করেছে, তার জন্য খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বেআইনিভাবে অভিবাসন করা মিয়ানমার নাগরিকের (রোহিঙ্গা) জন্য মানবিক সহায়তা।’

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, বিরাজমান রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত রয়েছে রাষ্ট্রহীনতার সমস্যা। এই রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী, অনুপ্রবেশকারী বা স্থানচ্যুত হিসেবে চিহ্নিত করা একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ, যার বড় ধরনের সুরক্ষাসংক্রান্ত তাৎপর্য রয়েছে। শরণার্থী শব্দের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি। একই সঙ্গে তাদের সমস্যার সমাধান এবং চাপ বহনের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপরও বর্তায়। সেদিক থেকে অনুপ্রবেশকারী অথবা স্থানচ্যুত হিসেবে চিহ্নিত করলে তারা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও তাদের দায়বদ্ধতা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হবে।

সম্ভবত রোহিঙ্গাদের চিহ্নিতকরণের সমস্যার কারণেই শরণার্থী মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বের ভূমিকায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনকে না দিয়ে অপর একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের বিপুলসংখ্যক শরণার্থী মোকাবিলার পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই। অন্যদিকে শরণার্থীসংক্রান্ত জাতিসংঘ হাইকমিশন অতীতে ১৯৭৮ সাল এবং ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে তাদের দেখভাল ও প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই সংস্থা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক শরণার্থী ও রাষ্ট্রহীনতা বিষয়ে বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত (ম্যান্ডেটেড) সংস্থা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জরুরি শরণার্থী মোকাবিলায় এর রয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা। একই সঙ্গে এর দায়বদ্ধতা রয়েছে জাতিসংঘের মহাসচিবের মাধ্যমে সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর কাছে। সুতরাং এ ধরনের একটি সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে শরণার্থী বিষয়ে অনভিজ্ঞ অপর একটি সংস্থার ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা গণহত্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বাংলাদেশে এসেছে। শরণার্থী নিরাপত্তা বিধান একটি জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়। এ ক্ষেত্রে ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, ওই ধরনের ভুলের খেসারত দিতে হবে হাজার হাজার শরণার্থীকে, যারা এখনই শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং যাদের অনেকেই জীবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ গুরুভার কালক্ষেপণ না করে দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা, যার পূর্বশর্ত হচ্ছে শরণার্থীকে শরণার্থী হিসেবে বিবেচনা করা এবং বাংলাদেশের সরকারকে সহায়তার জন্য এমন প্রতিষ্ঠানকে মূল দায়িত্ব দেওয়া, যার যোগ্যতা ও দক্ষতা রয়েছে এবং একই সঙ্গে যে সংস্থা জাতিসংঘের আদর্শ ও নীতিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

সি আর আবরার: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সমন্বয়ক রামরু।