ভারতীয় ঋণ: বিশেষজ্ঞ মত

ভারতের সঙ্গে তৃতীয় এলওসিতে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বিষয়ে কথা বলেছেন দুজন অর্থনীতিবিদ

ঋণের সুফল পেতে হলে
মুস্তাফিজুর রহমান
ভারতের সঙ্গে ৪৫০ কোটি ডলারের নতুন একটি ঋণচুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ধরনের এই ঋণের ধারায় গত সাত বছরের মধ্যে এটি এ ধরনের তৃতীয় চুক্তি। লাইন অব ক্রেডিটের অর্থ হলো, এই ঋণের অর্থ খরচ করবে বাংলাদেশ, তবে তা বিশেষ কিছু শর্তের আওতায়। বিশেষ কিছু প্রকল্পেই কেবল এ অর্থ ব্যয় করা যাবে এবং সেই ব্যয়ের সিংহভাগই ঋণদাতা দেশের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করতে হবে। নতুন এই ঋণচুক্তির আওতায় ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। সব মিলিয়ে দেড় শতাংশ সুদ, সহজ শর্তে এই ঋণ আমরা পেতে যাচ্ছি। যোগাযোগ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো নির্মাণের এই প্রকল্পগুলো আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই আশা করা যায়।
এই প্রকল্পগুলোর একটি অংশ ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত ট্রানজিট চুক্তির অবকাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্যে হলেও তা আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা সৃষ্টিতেও অবদান রাখবে। তৃতীয় ঋণচুক্তির তালিকায় থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ বিতরণ অবকাঠামো উন্নয়ন; পায়রা বন্দরের বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ; বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার ও তীর সংরক্ষণ; কাটিহার-পার্বতীপুর-বরনগর দিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন তৈরি; মোল্লাহাটে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এক লাখ এলইডি বাল্ব সরবরাহ প্রকল্পগুলো আমাদের নিজস্ব প্রয়োজন মেটাবে।
অন্যদিকে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ নির্মাণ; সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নতকরণ; বেনাপোল-যশোর-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা সড়ককে চার লেনে উন্নীত করা; চট্টগ্রামে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ; ঈশ্বরদীতে কনটেইনার ডিপো নির্মাণ; মোংলা বন্দর উন্নয়ন; চট্টগ্রামে ড্রাই ডক নির্মাণ; মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত চার লেনে সড়ক উন্নীত করা; মিরসরাই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন; কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হয়ে সরাইল পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণ; মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রেলপথ নির্মাণ ভারতের ট্রানজিট বাস্তবায়নে যেমন, তেমনি যৌথ স্বার্থেও কার্যকরী হবে। এটা আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এসব প্রকল্প তাদের ঠিকাদার ও মালামাল দিয়ে তৈরির কথা থাকলেও তা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। খেয়াল করার বিষয়, তাদের টাকায় তাদের দেশ থেকে জিনিস আনতে হবে। এখানেই আমাদের জন্য দর-কষাকষির সুযোগ আছে। আগে ঋণের টাকার ৮৫ শতাংশ ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যয়ের বিধান থাকলেও তৃতীয় এলওসিতে তা ৬৫ এবং ৭৫-এ আনা হয়েছে। এখানে আমাদের আরও দর-কষাকষি করতে হবে। প্রকিউরমেন্ট বা কেনাকাটায় প্রতিযোগিতা-সক্ষমভাবে আমাদের হিস্যা বাড়াতে হবে। যেহেতু এক দেশ থেকেই টেন্ডার আসবে, সেহেতু বেশি দামে যাতে নিতে না হয়, তা দেখতে হবে। এখানে যেহেতু আন্তর্জাতিক টেন্ডার হচ্ছে না, সেহেতু ৫০ লাখ টাকার বাসের দাম ষাট লাখ টাকা যাতে দিতে না হয়, তা দেখতে হবে। আর তা নিশ্চিত করতে হলে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে আসার দরকার হবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইকোনমিক জোন বা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের বিনিয়োগ করার কথা আছে। পদ্মা সেতুর সুবিধা চূড়ান্ত করতে হলে ওই সব বিনিয়োগও আমাদের লাগবে। এসব প্রকল্প সাশ্রয়ীভাবে করা, সময়মতো করার জন্য নিজেদের হোমওয়ার্ক করার দরকার আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হলে খরচ বেড়ে যাবে, তখন ওই বাড়তি অর্থ আমাদের তহবিল থেকে জোগাতে হবে। এ জন্য প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ সমান্তরালভাবে এগিয়ে রাখতে হবে।
আমাদের এখন দেখতে হবে প্রকল্প বাস্তবায়নের হার যাতে বাড়ানো যায়। তা করতে হলে প্রকল্পগুলোর জন্য জমি অধিগ্রহণ, টেন্ডার প্রণয়ন, প্রকল্পের নকশা তৈরি, টেন্ডার ছাড়া এবং টেন্ডার চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গ সমন্বয় করে নিতে হবে এবং কাজগুলো করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে। কেননা প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা বাড়লে খরচও বাড়বে। বেশি সময় মানে বেশি সুদ, আর তা মেটাতে গিয়ে প্রত্যাশিত ফলও পাব না। এটা নীতিগত প্রশ্ন।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের নিজস্ব সক্ষমতাও বাড়বে। তবে প্রকল্প থেকে প্রকল্প ধরে দর-কষাকষি করতে হবে আমাদের। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কেনাকাটার বিষয়গুলো দ্রুত দৌড়াচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই অবকাঠামো নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে। এটা কাঙ্ক্ষিত নয়।

ড. মুস্তাফিজুর রহমান: অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক।

দর-কষাকষির প্রস্তুতি থাকতে হবে আমাদের
কে এ এস মুরশিদ

ভারতের সঙ্গে নতুন আরেকটি এলওসি ঋণচুক্তি করা হলো। প্রথম এলওসিতে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা ছাড় হয়েছে, দ্বিতীয়টাতে হয়ইনি। এরপরও আমি বলব, এ ধরনের ঋণচুক্তি আসলে আমাদের কার্যকর করতে হবে। কারণ, আমাদের চাহিদা অনেক বেশি। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবকাঠামো সমস্যা রয়েছে। বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন করতেই হবে। অবকাঠামো উন্নয়নে এসব ঋণচুক্তিগুলোর প্রয়োজন আছে। তবে বিনিয়োগের অর্থ ব্যবহার করতে না পারলে লক্ষ্য পূরণ হবে না। তাই আমাদের ঋণ ছাড়ে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে, সেগুলো শিথিল করতে হবে। তা না হলে আমরা লাভবান হব না। ঋণ ছাড়ে বা ব্যবহারে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারও আনতে হবে।

চুক্তির শর্ত হচ্ছে ভারতীয় ঠিকাদারেরাই প্রকল্পের কাজ পাবেন। ঋণের টাকার পূর্তকাজের প্রকল্প হলে ৬৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা ভারত থেকে আনতে হবে। অন্য প্রকল্পে ৭৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা ভারত থেকে আনতে হবে। আসলে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো এমনই হয়ে থাকে। আমাদের চীনের সঙ্গে যে চুক্তি আছে, সেগুলোও এমন ধরনের শর্তেই আছে। এটা খুব ভালো হতো যদি যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি সাশ্রয়ী হয়, সেখান থেকে মালামাল নেওয়া যেত এবং তা নির্ধারণে আমাদের আরও স্বাধীনতা থাকত। তবে দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্র আসলে এমনটা দেখা যায় না। কারণ, তারা ঋণ দিচ্ছে এই সবকিছু শর্ত মেনে নেওয়ার ভিত্তিতেই। যেহেতু এতে আমাদের ইচ্ছা আছে, তাই এই চুক্তি হচ্ছে।

তবে এ ক্ষেত্রে আলোচনা করে যতটুকু আমাদের পক্ষে নেওয়া যাবে, সেটাই লাভ। সেই মানসিকতা, প্রস্তুতি এবং রূপরেখা আমাদের থাকতে হবে। বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে আমরা যে ঋণ নিই, সে ক্ষেত্রে এ ধরনের শর্ত থাকে না। চীন হোক বা ভারত হোক, তাদের তো একটি এজেন্ডা থাকবেই। আমাদের দেখতে হবে কিসে আমাদের লাভ এবং কিসে ক্ষতি। তাই অন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ক্ষেত্রে যেসব শর্তে ঋণ নেওয়া হয়, অনুরূপ শর্তে ঋণ নেওয়া হলে বলার কিছু দেখি না।

কে এ এস মুরশিদ: অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক।