'তুমি সুন্দর যদি নাহি হও'

বিবাহিত জীবনের প্রায় এক যুগ পার হতে চলেছে। ব্যক্তিজীবনে দুটি সন্তানের মা আমি। বিয়ের আগে বা পরে কখনোই নিজেকে নিজের কাছে বা অন্যের চোখে অসুন্দর বলে মনে হয়নি। আমার সন্তানদের চোখে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মা, স্বামীর কাছে প্রিয়তমা স্ত্রী এবং অনিবার্যভাবে মা-বাবার চোখে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সন্তান। আমার বন্ধুদের কিংবা সহকর্মীদের কাছে আমি বিয়ের আগে যে আন্তরিকতা এবং মনোযোগ পেয়েছি, এখনো তা-ই পেয়ে আসছি। কিন্তু বিবাহিত বলে যে কোনো মানুষের সৌন্দর্য কমে যেতে পারে, সেই ধারণা পেলাম ‘বিবাহিত’ তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর জান্নাতুল নাঈমের কাছ থেকে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের খেতাব কেড়ে নেওয়ার পর। বিবাহিত নারী হিসেবে এটা আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। প্রতিযোগিতার শর্ত ছিল প্রতিযোগীকে ‘অবিবাহিত’ হতে হবে। জান্নাতুল সেই শর্ত পূরণ করতে পারেননি বলেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু এতে অন্তত একটা জিনিস পরিষ্কার হয়েছে যে সৌন্দর্যের সঙ্গে ‘বিবাহিত’ বা ‘অবিবাহিত’ এর কোনো সম্পর্ক নেই। জান্নাতুল নাঈম ‘বিবাহিত’ এই তথ্যটি যদি প্রকাশ না পেত, তাহলে তিনি ‘খেতাব’ ঠিকই ধরে রাখতে পারতেন।

জান্নাতুল নাঈম সম্পর্কে প্রথম অবগত হই সামাজিক যোগাযোগের একটি মাধ্যম থেকে। আমার এক পরিচিত জান্নাতুল নাঈমের আগের আর বর্তমানের দুটি ছবি পাশাপাশি রেখে স্ট্যাটাস দিয়েছেন এভাবে, ‘ক্যামেরার কারসাজি আর মেকআপের ঘষামাজা কত কিনা করে!’ সৌন্দর্যের মুকুটধারী বিজয়িনীর কথা যদি বাদও দিই, জানি না কোনো মেয়েকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ্যে এভাবে অপমান করার অধিকার কারও আছে কি না! আর প্রতিযোগিতার শর্তে সম্ভবত কোথাও নেই যে অংশগ্রহণকারী মেকআপ করতে পারবেন না। উপরন্তু এ প্রতিযোগিতায় নাঈম একাই মেকআপ করেননি; বরং মেকআপ করেছেন প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এবং সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন ব্যক্তির এ ধরনের রুচিহীন ও নোংরা মন্তব্যে সত্যিই আহত হয়েছি আমি। পরবর্তী সময়ে আরও বেরিয়ে আসে সেরা সুন্দরী নির্বাচনের প্রক্রিয়ার বেশ কিছু অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা। আলোচনায় আসে শেষ মুহূর্তের চূড়ান্ত বিজয়ী নির্বাচন নিয়ে আয়োজকদের সঙ্গে বিচারকদের মতপার্থক্যের বিষয়টি।

নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হলে তা তদন্তের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই রয়েছে। তবে অবাক করার বিষয় হলো জান্নাতুল নাঈমের সৌন্দর্য প্রকৃতিপ্রদত্ত, নাকি মেকআপের অবদান; মফস্বল শহর আর গুলশান-বনানীর বিউটি পারলারের মেকআপ শিল্পের তুলনামূলক আলোচনা কিংবা নাঈম বিবাহিত না অবিবাহিত এ নিয়ে মানুষকে যতটা কৌতূহলী ও আগ্রহী হতে দেখেছি, সেরা সুন্দরী নির্বাচন প্রক্রিয়ার অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি নিয়ে তাঁদের সে মাত্রায় প্রতিবাদী হতে দেখিনি। এসব আলোচনার সূত্রেই জানতে পেরেছি যে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার অন্যতম শর্ত নাকি প্রার্থীকে অবিবাহিত হতে হবে। এই শর্তই নাকি যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। সুন্দরী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বয়স একটি শর্ত হতে পারে। কিন্তু প্রার্থীর বৈবাহিক অবস্থা এ ক্ষেত্রে সত্যিই অত্যন্ত রুচিহীন একটি শর্ত এবং তা হাস্যকরও বটে। প্রশ্ন আসে মনে, তাহলে কি বিবাহের মাধ্যমে একজন নারীর সৌন্দর্যের পরিসমাপ্তি ঘটে? আর যদি অবিবাহিত শর্ত জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে নারীর কুমারীত্বকে ইঙ্গিত করা হয়, তবে তা একজন নারীর জন্য যে কতটা অপমানজনক, বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই একুশ শতকে বসবাস করে একজন নারী এসব শর্ত মেনে নিয়ে এ ধরনের প্রতিযোগিতায় কেন অংশ নিচ্ছেন, তা-ও তলিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। জানতে পেরেছি, বাংলাদেশে এবারের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় প্রাথমিক বাছাইপর্বে নাকি মোট ২৫ হাজার নারী অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধাপে বাছাইয়ের পর মোট ১০ জন চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। অনেকেই জান্নাতুল নাঈমের প্রশংসা করেছেন এ জন্য যে ১৬ বছর মতান্তরে ২৩ বছর বয়সে বিয়ে এবং পরবর্তী সময়ে বিবাহবিচ্ছেদের পরও তিনি মনোবল হারাননি, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, অংশ নিয়েছেন সুন্দরী প্রতিযোগিতায় এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছেন। তাই তিনি সাহসিকতার এক অনন্য উদাহরণ। কিন্তু সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য সুন্দরী নির্বাচনের এই ধরনের মঞ্চ কতটা যৌক্তিক, সেই প্রশ্নও মনে জেগেছে। অন্যান্য বছরের সংখ্যা যদি বাদও দিই, তারপরও শুধু এই বছরেই সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী বিপুলসংখ্যক তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি নারী কি তাহলে বিশ্বাস করেন সৌন্দর্যই সাহসিকতা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম! তাঁদের শক্তি, সামর্থ্য ও সক্ষমতা প্রকাশের জন্য আমরা কি তাহলে অন্য কোনো মঞ্চ তৈরি করতে পারিনি?

নিজেকে উদার দাবি করেন এমন অনেকে নারী-পুরুষ সাম্যের বিষয়টি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ছেলেদের জন্য নাকি এই ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন প্রয়োজন। অবাক লাগে, আমরা আমাদের চিন্তার জগৎকে কতটা সংকীণ করে ফেলেছি। নিজেদের পণ্যরূপে অন্যের সামনে তুলে ধরতে, এ ধরনের আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতায়, উৎসাহ প্রদানে কিংবা বিকৃত মন্তব্য প্রদানে আমাদের আগ্রহের যেন সীমা নেই। তাই তো আজও দেখি, তথাকথিত প্রগতিশীল ও শিক্ষিত সমাজের মাঝেও মেয়ের গায়ের রং কালো হওয়ার অপরাধে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা। অন্যদিকে এবারের সেরা ১০ প্রতিযোগীর মধ্যে একাধিক প্রতিযোগীর অপরিণত বয়সে বিয়ের খবর সরকারকে আরেকবার স্পষ্ট বার্তা দেয় যে বাংলাদেশে কন্যাশিশু বিবাহের চিত্র কতটা ভয়াবহ। সরকার এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির দাবি করলেও বাস্তব চিত্র কিন্তু আলাদা।

নারীর ক্ষমতায়নের কথা বিবেচনায় নিলে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে মুনাফা লাভের চেষ্টার পরিসমাপ্তি ঘটা জরুরি। সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা ছাড়াও শক্তি, সাহসিকতা কিংবা মননশীলতা প্রকাশের আরও অনেক সৃজনশীল মাধ্যম রয়েছে। সে মাধ্যমগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে এবং সবাইকে আগ্রহী করে তুলতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা। প্রয়োজন সচেতনতা ও মানসিকতার পরিবর্তন। আজকের নারী শাণিত হোক তাঁর শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানে-গরিমায়, শৌর্য ও শক্তিতে। নারী মহিমান্বিত হোক তাঁর মেধায়, মননে আর অন্তরের সৌন্দর্যে। মনের শক্তি, আর সৌন্দর্যই হোক প্রকৃত সৌন্দর্য পরিমাপের মানদণ্ড।

নিশাত সুলতানা: কর্মসূচি সমন্বয়ক, জেন্ডার জাস্টিস ডাইভার্সিটি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক।