রূঢ় সত্যের সহজ উচ্চারণ

পরিসংখ্যান শাস্ত্রে ‘ভ্যারিয়েন্স’ বিংবা ‘স্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন’ বলে কিছু সূত্র আছে। কোনো একটি সংখ্যা বা অবস্থানকে ‘মান’ হিসেবে ধরে সমগোত্রীয় অন্যদের সঙ্গে তার দূরত্ব বিচার করার জন্য এই সূত্র ব্যবহার করা হয়। সমাজজীবনে আমরা বুঝে হোক কিংবা না বুঝে এক ধরনের ‘মান’ আরোপ করে অন্যদের তার সঙ্গে তুলনা করি। সাদৃশ্য পেলে গ্রহণ করি, বৈসাদৃশ্য পেলে অনেক সময় ঠেলে সরিয়ে দিই বা উপেক্ষা করি। অনেক সময় আমরা বুঝতে চাই না, গাণিতিক সূত্র যান্ত্রিকভাবে সমাজজীবনে সব সময় প্রয়োগ করা যায় না। সমাজে নানা রকমের মানুষ আছেন। তাঁদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। যাঁরা মোটামুটি প্রতিনিধিত্বশীল, তাঁরা সবাই নিজ নিজ দোষে-গুণে স্বতন্ত্র এবং অনন্য। সবাইকে এক ছাঁচে ফেলে মাপা যায় না, উচিতও নয়। আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইটি পড়তে পড়তে আমার এ রকম মনে হলো।

যাঁদের বয়স একটু বেশি এবং পত্রপত্রিকা ও রাজনীতি ঘাঁটাঘাঁটি করেন, আবুল মনসুর আহমদ তাঁদের কাছে পরিচিত। নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই তিনি অপরিচিত। ১৯৪০-এর দশক থেকেই তাঁর লেখালেখি, সাংবাদিকতা। রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছিলেন তারও আগে। গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখেছেন অনেক। তাঁর রাজনীতিবিদ পরিচয়ের সঙ্গে লেখক পরিচিতি প্রবহমান ছিল সমান্তরালভাবে। উঠতি বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের মধ্যে যাঁরা রাজনীতিকে উপজীব্য করে ইতিহাস লেখার প্রয়াস পেয়েছেন, আবুল মনসুর আহমদকে তাঁদের প্রথম সারির বলা যেতে পারে। তাঁর আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইটি ১৯২০ সাল থেকে ১৯৭০ দশকের মধ্যবর্তী সময়ের একটি দলিল। এটা আমাদের পেছন ফিরে নিয়ে যায় টানাপোড়েনের ওই দশকগুলোতে, যখন রাজনীতিতে ভাঙাগড়ার খেলা চলছিল অবিরাম।
যেকোনো ব্যক্তি, ঘটনা বা সময়কে নানা আঙ্গিকে দেখা বা বিচার করা যায়। এখানে লেখকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রেণি-অবস্থান এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। আবুল মনসুর আহমদও তার ব্যতিক্রম নন। বইটি তিনি উত্তমপুরুষে লিখলেও এটা ঠিক রোজনামচা বা নিছক স্মৃতিকথা নয়। এটা একটা সময়ের দলিল। রেফারেন্স-কণ্টকিত না হয়েও এটাকে ইতিহাসের বই বললে অত্যুক্তি হবে না। তবে তার বয়ান যে শতভাগ নির্মোহ, এ দাবি হয়তো করা যাবে না। আগেই বলেছি, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা মানসিকতার চাদর ছুড়ে ফেলে সময়কে দেখার কঠিন কাজটি একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদের পক্ষে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। তিনি তাঁর মতো করে অন্যদের দেখেছেন। অন্যরা হয়তো তাঁদের মতো করে আবুল মনসুর আহমদকে বিশ্লেষণ করবেন, যা তিনি নিজে এ বইয়ে করেননি।
আবুল মনসুর আহমদের রাজনীতিজ্ঞান বা ভাবনা স্কুলজীবনেই শুরু হয়েছিল। তিনি নিজেই লিখেছেন, তাঁর মনের গভীরে দুটো জিনিস গভীরভাবে ছাপ রেখেছিল—দেশপ্রেম ও মুসলমানিত্ব। এই বোধের উৎস খুঁজতে হলে ওই সময়ের প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে। ভারত তখন ব্রিটেনের উপনিবেশ। দেশপ্রেম তখন তরুণমনের সহজাত প্রবণতা, যার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাদেরই একজন আবুল মনসুর আহমদ। অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব এবং টানাপোড়েন মুসলমান যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মপরিচয়ের জিজ্ঞাসা তৈরি করেছিল। এখন এটাকে কেউ কেউ ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলে সংজ্ঞায়িত করে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও, ওই সময়ের প্রেক্ষিতে এটাই ছিল বাস্তবতা। কাজী নজরুল ইসলাম, মুজফফর আহমদ কিংবা হুমায়ুন কবিররা ছিলেন ব্যতিক্রম। ‘বাঙালী জাতীয়তা বনাম ভারতীয় জাতীয়তা’ প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমদ খোলামেলাভাবেই বলেছেন, ‘নিখিল ভারতীয় ভিত্তিতে হিন্দুরা যে নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক শাসন চাহিতেন, বাংলার বেলা তা চাহিতেন না। বাঙালী হিন্দুরা বাংলায় মেজরিটি শাসন ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন উভয়টারই বিরোধী ছিলেন।... গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় ভোটাধিকার প্রসারে বাংলার রাষ্ট্রীয় অধিকার মেজরিটি মুসলমানের
হাতে চলিয়া যাইবে এটা যেদিন পরিষ্কার হইয়া গেল, সেইদিন হইতেই হিন্দুর মুখে বাঙালী জাতিত্বের কথা, বাংলার কৃষ্টির কথা আর শোনা গেল না। তার বদলে “ভারতীয় জাতি”, “ভারতীয় কৃষ্টি”, “মহাভারতীয় মহাজাতি” ও “আর্য্য সভ্যতার” কথা শোনা যাইতে লাগিল...।’
আবুল মনসুর আহমদ যেটা বলেননি, তা হলো, বাংলার মুসলমান ভারত ভাগ চেয়েছিল, কারণ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মুসলমানরা ছিল সংখ্যালঘু। তারা বাংলার বিভক্তি চায়নি, কারণ এখানে তারা ছিল সংখ্যাগুরু। সংখ্যাতত্ত্ব আর জাতীয়তাবাদ একাকার হয়ে গিয়েছিল। এখানে একটা সরল উপসংহার টানা যায় যে, ওই সময় ভারত ভাগ না হলে বাংলা ভাগ হতো না। বলা যায়, ‘পাকিস্তান’ ছিল অখণ্ড ভারতে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের জাত্যভিমান’ (মেজরিটি শভিনিজম)-এর প্রতিক্রিয়া। তাই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ থেকে শুরু করে শেরেবাংলা ফজলুল হক পর্যন্ত তাবত নেতা ‘অসাম্প্রদায়িক’ চেতনা নিয়ে রাজনীতি শুরু করলেও শেষমেশ মুসলিম লীগের ঝান্ডা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। আবুল মনসুর আহমদের রাজনীতির যাত্রা আরও অনেকের মতো শুরু হয়েছিল কৃষক-প্রজা সম্মেলনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে। পরে তাঁরা সবাই মুসলিম লীগের গাড়িতে সওয়ার হয়েছিলেন।
যে পাকিস্তান তাঁরা চেয়েছিলেন, বাস্তবে তা তাঁরা পাননি। বাঙালি মধ্যবিত্ত যুব সম্প্রদায়ের মোহমুক্তি ঘটতে বেশি দেরি হলো না। মুসলিম লীগের তরুণ কর্মীরা ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় গঠন করলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ এটাই ছিল পাকিস্তানের প্রথম সংগঠিত বিরোধী দল। আবুল মনসুর আহমদ কলকাতার পাট চুকিয়ে নিজ জেলা ময়মনসিংহে আসেন ১৯৫০ সালের এপ্রিলে। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ তৈরি হলো। তিনি হলেন এর সভাপতি। ১৯৫৩ সালে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি রেখে তাঁকে অন্যতম সহসভাপতি নির্বাচন করা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরোদস্তুর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৪ সালে প্রদেশে সাধারণ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং শেরেবাংলার কৃষক-প্রজা পার্টি ও আরও কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট নয়টি বাদে সব আসনে জয়ী হয়। শেরেবাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা তৈরি হলে আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমানসহ দলের পাঁচজন মন্ত্রিসভায় জায়গা পান।
সাংবাদিকতা ও লেখাজোখায় হাত থাকার কারণে আওয়ামী লীগের অনেক দলিলের মুসাবিদা করতে হতো আবুল মনসুর আহমদকে। যে ২১ দফা ইশতেহারের ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, তার রচয়িতা ছিলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের মধ্যে দলাদলি ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান যখন আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটান, তখন তাঁর সঙ্গে আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান প্রমুখ জ্যেষ্ঠ নেতা একমত ছিলেন না। তাঁরা আওয়ামী লীগের বাইরেই থেকে যান। তখন থেকেই আবুল মনসুর আহমদ আর সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে নেই। তবে প্রয়োজনে তিনি সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের যে সংক্ষিপ্ত ফর্মুলা উপস্থাপন করেছিলেন, তাকে ভিত্তি করে ‘আমাদের বাঁচার দাবী ছয় দফা কর্মসূচী’ নামে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ একটি পুস্তিকা লেখেন। এটা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ছাপা হয়েছিল।
আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইটি লেখা শেষ হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি এই বইয়ে আরও কয়েকটি অধ্যায় জুড়ে দিয়ে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত সময়টিকে ধরে রেখেছেন। এতে অবশ্য তাঁর লেখার ধারাবাহিকতা তেমন ক্ষুণ্ন হয়নি।
১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও কয়েকটি আসনে নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আবুল মনসুর আহমদের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘তিনশ পনর সদস্যের পার্লামেন্টে জনা-পঁচিশেক অপজিশন মেম্বর থাকিলে সরকারি দলের কোনোই অসুবিধা হইত না। বরঞ্চ ওইসব পার্লামেন্টারীয়ান অপজিশনে থাকিলে পার্লামেন্টের সৌষ্ঠব ও সজীবতা বৃদ্ধি পাইত।...বাংলাদেশের পার্লামেন্ট পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের একটা ট্রেনিং কলেজ হইয়া উঠিত। আর এসব শুভ পরিণামের সমস্ত প্রশংসা পাইতেন শেখ মুজিব।’
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদের মন্তব্য বেশ চাঁছাছোলা। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, এমনটা তিনি মনে করেন না। তাঁর মতে, ‘এক পাকিস্তানের জায়গায় দুই পাকিস্তান হইয়াছে। ভারত সরকার লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের সাহায্য করিয়াছেন।...লাহোর প্রস্তাবে “পাকিস্তান” শব্দটার উল্লেখ নাই, শুধু মুসলিম মেজরিটি রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। তার মানে রাষ্ট্রের নাম পরে জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়ার কথা। পশ্চিমা জনগণ তাদের রাষ্ট্র-নাম রাখিয়াছে “পাকিস্তান”। আমরা পুরবীরা রাখিয়াছি “বাংলাদেশ”। এতে বিভ্রান্তির কোনো কারণ নাই।’
পুরো বইজুড়ে আবুল মনসুর আহমদ এ ধরনের অনেক রূঢ় সত্য উচ্চারণ করেছেন সহজ–সরলভাবে। হাস্যরস ও তির্যক ইঙ্গিতের মাধ্যমে রাজনীতির অনেক জটিল গেরো তিনি সহজিয়া ভঙ্গিতে উন্মোচন করেছেন। প্রায় পৌনে সাত শ পৃষ্ঠার এই বই পড়তে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না। এটা যে একটা নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স বই, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি নিজে বহুবার আমার লেখায় এ বই থেকে উদ্ধৃত করেছি।

আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর: আবুল মনসুর আহমদ। প্রথম প্রথমা সংস্করণ: সেপ্টেম্বর ২০১৭। প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
[email protected]