মিয়ানমার সম্পর্কে যেসব কথা জানা দরকার

মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সঙ্গে অং সান সু চির করমর্দন
মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সঙ্গে অং সান সু চির করমর্দন

মিয়ানমারের তরফ থেকে একজন মন্ত্রী সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। পদক্ষেপটি ইতিবাচক হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে সমস্যাটি সমাধানের জন্য বহুপক্ষীয় উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ হলেও এখন পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। এই কারণে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের সম্যক উপলব্ধি থাকা জরুরি। বিশেষ করে এটা এই কারণে দরকার যে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংকটে বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ অনেকটাই একাকী হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের শাসনব্যবস্থা অন্যান্য দেশ থেকে একদম আলাদা। ইংরেজ সাংবাদিক রুডইয়ার্ড কিপলিং বলেছেন, ‘এই হচ্ছে মিয়ানমার, যা আপনার চেনাজানা যেকোনো দেশ থেকে স্বতন্ত্র।’ দেশটির অদ্ভুত শাসনব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সম্প্রতি দেশটি গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করলেও এর ভিত এখনো শক্ত হয়নি। সেনাবাহিনী এখনো অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব বজায় রেখেছে। এ ছাড়া দেশটির জনসাধারণের ওপর বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং জ্যোতিষীদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। দেশটির রাজনীতির গতিশীলতা এবং রোহিঙ্গা সংকট বুঝতে হলে সরকার, সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য প্রভাবকের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বিশ্লেষণ করতে হবে। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে প্রথম উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর এ দেশে আগমন ঘটেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করা হয়নি। মিয়ানমার হচ্ছে ভারত ছাড়া বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিবেশী রাষ্ট্র। কিন্তু সে অর্থে মিয়ানমারের সঙ্গে আমরা গভীর যোগাযোগ স্থাপন করতে পারিনি। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ খুবই সীমিত। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভ্রমণ কালেভদ্রে হয়ে থাকে। ‘স্টেট কাউন্সেলর’ হওয়ার পর অং সান সু চি ইতিমধ্যে প্রতিবেশী সব দেশে রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন; কেবল বাংলাদেশ বাদে। রোহিঙ্গা সংকট দুই কারণে জটিল—দেশটির কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থান এবং এর অভ্যন্তরীণ অদ্ভুত শাসনব্যবস্থা।
মিয়ানমারের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দুই আঞ্চলিক শক্তি চীন এবং ভারতের সঙ্গে দেশটির সীমান্ত রয়েছে। দেশটি দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। দেশটির দক্ষিণে রয়েছে সামুদ্রিক কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর দুটি করিডরের সঙ্গে মিয়ানমার সংযুক্ত। জ্বালানি তেল আমদানি এবং বৈশ্বিক বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চীনা জাহাজগুলোকে ‘মালাক্কা প্রণালি’ দিয়ে ঘুরে যেতে হয়, যা একই সঙ্গে সময় এবং অর্থসাপেক্ষ। কিন্তু রাখাইনে অবস্থিত সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয় হয়। মিয়ানমারে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিপরীতে ভারতও দেশটিতে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘কালাদান বহুমুখী যোগাযোগ প্রকল্প’। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে যোগাযোগের জন্য ‘চিকেন’স নেক’-এর বিকল্প পথ তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে জাপান এবং রাশিয়ার বেশ কিছু বৃহৎ প্রকল্প রয়েছে। এ প্রকল্পগুলো চলমান রাখার জন্য রাখাইন রাজ্যের স্থিতিশীলতা অত্যাবশ্যকীয়। রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ মিয়ানমারের অনুকূলে রয়েছে।
মিয়ানমারের বর্তমান জটিল অবস্থা বুঝতে হলে এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা দরকার। সম্প্রতি গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে দীর্ঘ কয়েক দশক দেশটিতে সামরিক শাসন জারি ছিল। তারও আগে দেশটি দীর্ঘকাল ব্রিটিশ ভারতের অধীনে ছিল। সে সময় ভারতবর্ষ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ সৈন্য, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এবং নির্মাণশ্রমিক হিসেবে মিয়ানমারে আগমন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মিয়ানমারের তৎকালীন রাজধানী রেঙ্গুনের জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ ছিল ভারতীয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজ জনগোষ্ঠী এটাকে তাদের সমাজ এবং ধর্মের ওপর হুমকি হিসেবে দেখা শুরু করে এবং ফলে ভারতীয়-বিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করেন এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে সামরিক শাসন জারি করেন। সব শিল্প, ব্যবসা এবং সংবাদমাধ্যম জাতীয়করণ করা হয়। ব্যাপকভাবে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের বহিষ্কারাভিযান শুরু হয়। কেবল ১৯৬৪ সালে ৩ লাখের বেশি ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি মিয়ানমার ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
দীর্ঘ সামরিক শাসনের ফলে দেশটির জনসাধারণের মধ্যে বেশ কিছু মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে, যা একান্তভাবে তাদের নিজেদের এবং সর্বসত্তা দিয়ে তারা সেটা বিশ্বাস করে। মিয়ানমারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী উ নু ঘোষণা করেন, দেশটির সাধারণ পরিচয় হবে একই ধর্ম—বৌদ্ধধর্মের ভিত্তিতে। পরবর্তী সময়ে জেনারেল নে উইন ঘোষণা করেন, একই ভাষা—বার্মিজ হবে মিয়ানমারের নাগরিকদের সাধারণ যোগসূত্র। সবশেষে জেনারেল থান স ঘোষণা করেন, দেশের সব নাগরিকের পরিচিতি একটি সাধারণ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভিত্তিতে হবে। মিয়ানমারের জনসাধারণের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি প্রবল আস্থা পরিলক্ষিত হয়, যেখানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অবস্থান বেশ ভঙ্গুর। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি অমূলক ভয় কাজ করে যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনবিন্যাসের পরিবর্তন করতে পারে। এই বিশ্বাস সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজ ও রাখাইনদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে।
বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপের ফলে মিয়ানমার সামরিক সরকার ২০০৮ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে, যার ভিত্তিতে ২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার ইতি টেনে দেশটি গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু সেনাবাহিনী, যা তাতমাদো নামে পরিচিত, গণতন্ত্রের আড়ালে সংবিধানের মধ্যে এমন একটা শাসনব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করেছে, যাতে দেশটির শাসনব্যবস্থায় তাদের প্রভাব অক্ষুণ্ন থাকে। এই নতুন সংবিধানের ভিত্তিতেই বর্তমান মিয়ানমার রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। সংবিধানের ধারা অনুসারে, সংসদের ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয়—পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্ত সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের নিয়ন্ত্রণও সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত হয়।
সংবিধান মোতাবেক সেনাপ্রধান নিজেই নিজের প্রতি দায়বদ্ধ। কার্যত তাঁকে স্টেট কাউন্সেলর কিংবা প্রেসিডেন্টের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সংবিধানমতে, সেনাপ্রধান কিছু ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের ওপরও হস্তক্ষেপ করতে পারেন। সংসদের উভয় কক্ষে সেনাবাহিনী থেকে আসা প্রার্থীদের মনোনয়ন করার ক্ষমতা সেনাপ্রধানকে দেওয়া হয়েছে। বস্তুত, মিয়ানমার রাষ্ট্রের মধ্যে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ সব বিষয় সেনাবাহিনী নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাইরের হস্তক্ষেপ সহ্য করে না। রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ/সীমান্ত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যেটা সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে এখানে একক ভূমিকা রাখা
কঠিন। এ সংকট নিরসনে কার্যকর সমাধানে পৌঁছাতে হলে সংকটের গুরুত্ব মিয়ানমার সেনাবাহিনীকেও বুঝতে হবে।
মিয়ানমারের জনসাধারণের মধ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রভাব অপরিসীম। জ্যোতিষীদের প্রভাবও উল্লেখ করার দাবি রাখে। দেশটিতে প্রায় ৫ লাখ বৌদ্ধ ভিক্ষু রয়েছে। ২০০৭ সালের ‘স্যাফ্রন রেভল্যুশন’-এ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী আসিন উইরাথু প্রচার করেন যে মিয়ানমারে বৌদ্ধধর্ম এখন হুমকির মুখে। এ ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশের উদাহরণ টেনে উইরাথু বলেন, এসব দেশ একসময় বৌদ্ধধর্ম প্রধান ছিল; কিন্তু এখন ইসলামের অধীনে চলে গেছে। তিনি মা বা থা নামক একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন, যা দেশটির ওপর ভিন্ন ধর্মের বিস্তার প্রতিরোধে আন্দোলন করে যাচ্ছে।
সরকারের মধ্যেও উইরাথুর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠান মা বা থা-এর প্রভাবে পূর্ববর্তী সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সংসদ কিছু আইন পাস করেছে। একটা আইন করা হয়েছে, যাতে বৌদ্ধ মেয়েদের ভিন্ন ধর্মের কেউ বিয়ে করতে না পারে। অন্য আরেকটা আইন করা হয়েছে, যাতে কেউ সহজে ধর্ম পরিবর্তন করতে না পারে। এ আইনগুলো মূলত বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অনুকূলে করা হয়েছে। দেশটির জ্যোতিষীরাও সরকারের কাছে ইসলামের বিস্তারের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। এমনকি সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণেও এই জ্যোতিষীরা ভূমিকা পালন করেন। জানা যায়, মিয়ানমারের রাজধানী রেঙ্গুন থেকে নেপিডোতে স্থানান্তরের পেছনেও জ্যোতিষীদের ভূমিকা ছিল। মিয়ানমারের জনসাধারণের মধ্যে মুসলিমবিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠার পেছনে বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং জ্যোতিষীদের ভূমিকা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করার দাবি রাখে।
রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সঙ্গে ফলপ্রসূ সমাধানে পৌঁছাতে হলে দেশটির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো, এর ইতিহাস এবং শাসনব্যবস্থার বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের বুঝতে হবে। দেশটির রাজনৈতিক পটভূমিতে গণতান্ত্রিক সরকার
ছাড়াও যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রভাব এবং ভূমিকা রয়েছে তাদের সম্পর্কে জানতে হবে। তাহলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে।

l আ ন ম মুনীরুজজামান: ঢাকায় অবস্থিত নিরাপত্তা চিন্তাশালা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি।