চীনের টাকার স্বচ্ছতা কম

এইডডেটা নামের এক প্রতিষ্ঠান বলছে, চীন দানগ্রহীতা দেশ থেকে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
এইডডেটা নামের এক প্রতিষ্ঠান বলছে, চীন দানগ্রহীতা দেশ থেকে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম’ নীতির আলোকে বৈদেশিক সাহায্যে বড় ধরনের কাটছাঁট করতে যাচ্ছেন। এতে জনহিতৈষী মানুষেরা শঙ্কায় পড়ে গেছেন। এমনকি এমন সতর্কবাণীও শোনা গেছে যে এটা কিছু দেশের জন্য ‘মৃত্যুদণ্ডের’ শামিল। নতুন খবরে জানা যায়, এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে গেলে চীন তার জায়গাটা নিতে চায়। অর্থাৎ সে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রধান অর্থদাতা হতে চায়। কিন্তু চীনের এই টাকা ব্যবহারের স্বচ্ছতা এবং গ্রহীতা দেশগুলোর ওপর এর কী প্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে বড় উদ্বেগ রয়েছে।

এইডডেটা নামের এক প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি চীনের প্রদত্ত বৈদেশিক সাহায্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ প্রকাশ করেছে। এই সংস্থার নীতি বিশ্লেষক সামান্থা কাস্টার বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি বাগাড়ম্বরের পথে চলে এবং বৈশ্বিক প্রভাব গুটিয়ে নেয়, তাহলে চীনের পক্ষে এই ফাঁকে ঢুকে পড়ে নিজের জায়গা সংহত করে নেওয়া সম্ভব হবে।’

উল্লেখিত বিবরণে প্রকাশ করা হয়েছে যে চীনের সহযোগিতার বড় এক অংশ যায় আফ্রিকার দেশগুলোতে। চীনের সাহায্যপ্রাপ্ত ১০ গ্রহীতার মধ্যে আফ্রিকার দেশগুলোর স্থান সাত নম্বরে। চীনের মোট ৭০৪টি প্রকল্প আছে। ২০০০-১৪ সাল পর্যন্ত অ্যাঙ্গোলা ও ইথিওপিয়া সম্মিলিতভাবে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের প্রকল্প পেয়েছে, যা তার মোট সাহায্যের ১০ শতাংশ। তবে এই সাহায্যকাণ্ডের বড় একটি অংশের তথ্য পাওয়া যায় না। এই প্রতিবেদনে সেদিকে আলো ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।

এইডডেটার নির্বাহী পরিচালক ব্র্যাড পার্কস সিএনএনকে বলেছেন, ‘চীনা সরকার প্রকৃতপক্ষে তার বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারটা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার অংশ মনে করে।’ সে কারণে চীনের বৈদেশিক সাহায্যের বড় একটি অংশ সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘চীনের সহযোগিতায় প্রবৃদ্ধির ব্যাপক উল্লম্ফন হয়।’ আবার এতে এটাও বলা হয়েছে, চীনের এই ব্যয়ের বড় একটি অংশ অতটা কার্যকর নয়। সহযোগিতার টাকা ব্যবহার করে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংস্কারের যে ধারা আছে, চীনের কারণে তা ব্যাহত হচ্ছে। ২০০০-১৪ সাল পর্যন্ত চীন ১৪০টি দেশে ৪ হাজার ৩০০-এর বেশি প্রকল্পে ৩৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অর্থায়ন করেছে। এইডডেটার তথ্যানুসারে এই একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রদত্ত সহযোগিতার পরিমাণ এর চেয়ে সামান্য বেশি, ৩৯ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। আর এই ১৫ বছরের মধ্যে পাঁচ বছর চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি ব্যয় করেছে।

তবে টাকার অঙ্কের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সহায়তার ধরনের মধ্যকার বড় একটি পার্থক্য চোখে পড়ে না। পার্কস বলেন, গত ১৫ বছরে চীনা সরকারের ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ মার্কিন সরকারের প্রায় সমান। কিন্তু তাদের প্রদত্ত অর্থের ধরন ভিন্ন। চীন বছরে অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহায়তা-ওডিএ) দিচ্ছে ৫০০ কোটি ডলার। মানুষ সাধারণভাবে এটাকে বৈদেশিক সাহায্যের সঙ্গে এক করে ফেলে। কিন্তু ব্যাপারটা হলো চীনের ব্যয়ের বড় খাত হলো আদার অফিশিয়াল ফ্লো (অন্যান্য আনুষ্ঠানিক সহায়তা-ওওএফ), যেটা ঠিক ওডিএর শর্ত পূরণ করে না, যার মধ্যে বাণিজ্যিক প্রকল্পও আছে। এই ওওএফ প্রকল্পের মধ্যে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মঞ্জুরি, রপ্তানি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অনুদান, বেসরকারি খাতের জন্য ভর্তুকি ও বেসরকারি উন্নয়নের জন্য অর্থায়নও আছে।

ওইসিডি বা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এই উভয় বর্গ নির্ধারণ করে, চীন যার সদস্য নয়। ফলে সে এই সংস্থাটির নীতি দ্বারা বাধিত নয়। পার্কস বলেন, ‘এই বিভাজন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, আমরা সেটা দেখিয়েছি। শুধু চীনা ওডিএ গ্রহীতা দেশগুলোতে বড় অর্থনৈতিক পরিবর্তন বয়ে আনে।’ তিনি আরও বলেন, এইডডেটা দেখেছে, চীনা ওডিএ দ্বিগুণ হয়ে গেলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। এর তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে চীনের বাণিজ্যমুখী ওওএফের নির্ণয়যোগ্য ভূমিকা দেখা যায় না। পশ্চিমা দাতাদের দানের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখা যায়। কিন্তু ব্যাপার হলো, ওডিএর তুলনায় ওওএফে চীনের ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।

এখন চীন বড় দাতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় সমালোচকেরা সতর্ক করে দিয়েছেন, চীনের টাকার কারণে পশ্চিমারা দানের টাকায় স্বল্প গণতান্ত্রিক দেশে সংস্কারের যে তাগাদা দেয়, সেটা ব্যাহত হতে পারে। এইডডেটার প্রাথমিক তথ্য নিয়ে যে দুটি সমীক্ষা হয়েছে, সেখানেও এই দাবির প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শিয়াওজুন লি আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগের চিত্র তদারক করে দেখেছেন, চীনের নিঃশর্তসহায়তার কারণে পশ্চিমাদের শর্তযুক্ত ঋণ অতটা কার্যকর হয় না। তিনি বলেছেন, চীনের সহায়তায় রাজনৈতিক শর্ত এক রকম থাকে না বলেই গ্রহীতা দেশগুলো একে অধিক আকর্ষণীয় মনে করে। কখনো কখনো পশ্চিমাদের সহায়তার তুলনায় এটি তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়, যা কার্যকরও বটে।

তাঁর ভাষ্য হলো, আফ্রিকার দেশগুলোকে বুঝতে হবে, শর্ত নয়, তাদের দরকার বিকল্প। চীনের সহায়তা ও উন্নয়ন খাতে অর্থায়ন সেই সুযোগ এনে দেয়। সে কারণে আফ্রিকার দেশগুলো উদারভাবে তা গ্রহণ করছে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংকও চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় রাখতে ঋণের শর্ত কমিয়েছে। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিয়েগো হার্নান্দেজ বলেছেন, নতুন দাতারা নানা আগ্রহ নিয়ে হাজির হচ্ছে। তাই মঞ্জুরির এই নতুন কাঠামোয় সংস্কার ও কার্যকারিতার মতো শর্তগুলো উপেক্ষা করা হতে পারে, সেগুলো অপ্রয়োজনীয় হতে পারে।

এইডডেটা বলছে, চীন দানগ্রহীতা দেশ থেকে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি–বিষয়ক খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। অর্থ ব্যয় ও তার প্রভাবের ক্ষেত্রে সে ঐতিহ্যবাহী ও পশ্চিমা দাতাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। যদিও বেইজিং বলছে, এই সহায়তা রাজনীতিনিরপেক্ষ, তারা পশ্চিমাদের মতো শর্তারোপ করে না, তাদের টাকা একদম রাজনীতিমুক্ত নয়। আফ্রিকার দেশগুলো বহুদিন ধরে চীন ও তাইওয়ানের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে রিপাবলিক অব চায়না ও বেইজিং সেসব দেশকেই সহায়তা দিয়েছে, যারা তাইওয়ানকে পরিত্যাগ করে রিপাবলিক অব চায়নাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

সিএনএন ডট কম থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

জেমস গ্রিফিথ: সিএনএন ডিজিটালের প্রযোজক