ফরসাই কি সুন্দরী?

দুই ভাইয়ের ঘরে এক মাসের ব্যবধানে জন্ম নিল দুই কন্যাসন্তান। একজনের গায়ের রং কালো, আরেকজনের ফরসা। দাদি কৃষ্ণবর্ণের নাতনিকে ডাকতেন কৃষ্ণা নামে। ওই ডাকে বর্ণবাদী আচরণ থাকলেও আদরে কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু কৃষ্ণার চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ভাই যে নিজেও তখন শিশু, সে কোনোভাবেই বোনকে সহ্য করতে পারত না। তার এক কথা, ‘ও কালো, আমাদের ঘরে থাকতে পারবে না। মা চলো, ওই বোনটাকে (চাচাতো) নিয়ে আসি।’ সুযোগ পেলেই নিজের বোনকে মারত। এ ছিল ছোটবেলার কথা। আজ দুই ভাইবোনই বড়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। মা-বাবাকে হারিয়ে কৃষ্ণা এখন ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল। তার সামনে ফিরে এসেছে ভাইয়ের সেই মানসিকতা। বোনকে বাইরে যেতে দেয় না, এমনকি বাসায় কোনো ছেলে এলে তার সামনেও যেতে দেয় না। ভাইয়ের এখন একটাই কথা, তোকে বিয়ে দিতে পারলে বাঁচি। কিন্তু তোকে কে বিয়ে করবে? আমি নিজেও তো কালো মেয়ে বিয়ে করব না। উচ্চমাধ্যমিক পাস, ভদ্র, সংসারী কৃষ্ণার মনে প্রশ্ন, এখানে তার কী দোষ? বাসায় আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশী যে-ই বেড়াতে আসে, মা-বাবাহারা কৃষ্ণার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করতে গিয়ে বলে বসেন, ‘তুই একটু ফরসা হইলে তো আর এত কষ্ট হইত না!’

এ তো গেল নিম্ন সাধারণ পরিবারের এক সত্যি গল্প। এবার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা বলি। চার বোন এক ভাই স্নিগ্ধারা। বাবা শিক্ষক। আর মা সংসার সামলান। বাবার একটাই ইচ্ছা, ছেলেমেয়েদের তিনি অনেক দূর পর্যন্ত পড়াবেন। এক মেয়ে ফরসা, অন্যরা কালো। এ নিয়ে মায়ের যেন চিন্তার শেষ নেই। যে-ই বাড়িতে বেড়াতে আসে, বলে, তোমার মেয়েদের চেহারা তো মিষ্টি কিন্তু কালো হয়েছে। স্নিগ্ধাদের বলত তোমরা এত কালো হলে কেন? কিন্তু ছোটবেলায় মন খারাপ হলেও বড় হতে হতে হয়তো এই কালো শব্দটা বোনদের অস্তিত্বে ঢুকে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব ভালো ফল করা স্নিগ্ধার এখন বিয়ের বয়স। বাড়ির লোকজন পাত্র খুঁজছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ডাক্তার, ব্যাংকার-কত রকমের পাত্র সমাজে। কিন্তু সবার প্রথম শর্ত, মেয়েকে সুন্দরী হতে হবে। মেয়ের জন্য পাত্র না পেয়ে স্নিগ্ধার মা একদিন বলেই বসলেন, ‘টিভিতে তো ফরসা হওয়ার কত ক্রিম দেখায়। একটু মাখতে পারিস না!’

বিয়ের বাজারে ফরসা মানুষের কদর বেশি থাকায় কালো মানুষও প্রসাধনী মেখে সাদা হতে চায়। আর যারা দ্রুত হতে চান, তাদের জন্য আছে এক সপ্তাহে রং ফরসাকারী ক্রিম। এর পেছনে দায়ী হীনম্মন্যতা ও বিজ্ঞাপনের প্রভাব। বাণিজ্যিক স্বার্থে বিজ্ঞাপনের ভাষাটা এমন হয় যেন গায়ের রং কালো হওয়াটা পাপ। এই রঙের কারণে অনেক মেয়েরাই আত্মবিশ্বাস পায় না। ভালো চাকরি পায় না, ভালো বর পায় না।

জীবনের প্রতিটি স্তরেই কালোদের কিছুটা হলেও বঞ্চনার শিকার হতে হয়। খেয়াল করলে দেখা যায়, মার্কেটে ফরসা একটু শিশুকে দেখলে অনেকে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে, দেখ, বাচ্চাটা কি সুন্দর। কেউ কেউ গাল টিপে একটু আদরও করে দেন। কিন্তু কালো শিশুর দিকে কারও চোখ পড়ে কি? স্কুল-কলেজেও সবার নজর ফরসা মেয়ের দিকে। ফরসা বান্ধবীর কাছে প্রায়ই প্রেম নিবেদন করে অনেক চিঠি আসে। আর বান্ধবীও বিষয়টি উপভোগ করলেও বলে, এসব আর ভালো লাগে না। আমাকে এত প্রস্তাব দেওয়ার কী আছে? অথচ গায়ের রং কালো বলে পাশের বান্ধবীর শুধু বন্ধুই হয়, প্রেম আর হয়ে ওঠে না। ফলে একধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হয় তার মধ্যে। এখানেই শেষ নয়।

এরপর যখন কর্মস্থলে যাবেন, সেখানেও দেখা যায় ফরসা সহকর্মীর কদর বেশি। শারীরিক গড়ন এক, দুজনেরই মিষ্টি চেহারা কিন্তু তারপরও দেখা যায় ফরসা সহকর্মীর গুরুত্ব যেন একটু বেশি। আর প্রতিষ্ঠানের বড় বড় কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারি যদি নারী হয়ে থাকেন, তবে অবশ্যই তাকে এই পদের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার পাশাপাশি অলিখিত যোগ্যতায় ফরসা হতে হবে।

আর ক্যামেরার সামনে যারা কাজ করেন, বিশেষ করে উপস্থাপনা ও সংবাদ পাঠিকা, তাদের গায়ের রং যা-ই হোক না কেন, মেকআপ দিয়ে সাদা করতেই হবে।

এই সুন্দরী আসলে কী? শুধুই কি গায়ের রং। ভাবলাম, গুগলে সার্চ দিই। প্রথমেই শো করল ইমেজ। সেখানে ভারী মেকআপে ঢাকা নায়িকাদের ছবি। এরপর উইকিপিডিয়ায় এল, যার নামে সুন্দরবনের নাম, সেই সুন্দরীগাছের বর্ণনা। এরপর ভাবলাম, বাংলা একাডেমির অভিধানে দেখি কী বলা হয়েছে। সৌন্দর্য মানে রূপ, মনোহর রূপমাধুরী (দৈহিক সৌন্দর্য), শোভা। আর সুন্দরী মানে রূপবতী রমণী। কোথাও ফরসা রঙের কথা বলা হয়নি।

ছোটবেলায় ভারতীয় চ্যানেলে একটি নাটক দেখেছিলাম। পাত্রপক্ষ এসেছে পাত্রী দেখতে। পাত্রী পছন্দ হলো। এবার এনগেজমেন্ট। আংটি পরানোর জন্য পাত্রীকে হাত বাড়াতে বলা হলো। কিন্তু যেই না পাত্রী হাত বাড়াল, পাত্রের চোখ ছানাবড়া। বলেই বসল এটা পাত্রী? আমি তো ওকে (পাত্রীর পাশে থাকা ছোট বোন, যার গায়ের রং ফরসা) মনে করেছি। এ কালো মেয়েকে কে বিয়ে করবে? মেয়ের মা-বাবা পাত্রকে অনেক অনুনয়বিনয় করলেন। কিন্তু পাত্র অটল। এরই মধ্যে পাত্রীর ছোট ভাই বাইরে থেকে দৌড়ে এসে খবর দিল, বড় বোনটি লটারিতে ৫০ লাখ টাকা পেয়েছে। এ কথা শুনেই পাত্র রাজি। কিন্তু পাত্রী মুখের ওপর বললেন, ‘না।’

এটা যে শুধু একটি নাটক তা নয়, উপমহাদেশে এ ঘটনা অহরহ ঘটছে। যে নিম্নবিত্ত পরিবারে একটি কালো মেয়ে আছে, সে পরিবারের মা-বাবারা সবচেয়ে ভালো বোঝেন, দেশে সরাসরি বর্ণবাদ না থাকলেও মেয়েদের গায়ের রং নিয়ে যা আছে তা কতটা ভয়াবহ।

কালো মানেই খারাপ কেন হবে। সব নেতিবাচক বোঝাতে কেন কালো শব্দটি ব্যবহার করতে হবে। কালোকে ‘অশুভ’, ‘নেতি’ বোঝাতে বোঝাতে তা ভাষার মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই মনে গেঁথে যায়।

যে মেয়েটি তার চমৎকার ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা-দীক্ষা, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পথচলার একজন দারুণ সঙ্গী হতে পারত, শুধু ঈশ্বর প্রদত্ত গায়ের রঙের কারণে যেখানে তার কোনো হাত নেই, সে কারণেই কি সে উপেক্ষিত হবে?

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক মেখলা সরকার বলেন, একটি সফল দাম্পত্য সম্পর্ক মূলত পারস্পরিক আকর্ষণ, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের দৃঢ় ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। অপরিচিত দুজন নর-নারীর মধ্যে তাদের বাহ্যিক ও আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য (যেমন-সৌন্দর্য, বয়স, বাচনভঙ্গি, এমনকি আর্থিক অবস্থান, ক্ষমতা ইত্যাদি) আকর্ষণ তৈরির ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজনীয় হতে পারে। কিন্তু দাম্পত্য সম্পর্কের প্রতিদিনের জীবনে এবং দীর্ঘ পথচলায় এ আকর্ষণ ক্রমেই ফিকে হয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার মায়া এবং নিবিড় বন্ধুত্ব একটি আনন্দময় সম্পর্কের অন্যতম নির্ধারক হয়ে ওঠে।

তাই একটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই একজন মানুষকে গায়ের রং নয়, তার গুণ দিয়েই বিবেচনা করতে শেখানো প্রতিটি পরিবারের দায়িত্ব। এই বোধটুকু শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও থাকতে হবে। কারণ, ছেলেরা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু বিয়ে করার সময় সেই সনাতনী চিন্তার বাইরে যেতে পারছে না। শিক্ষিত মানে পাস করা নয়, জ্ঞানের আলো মনে ফোটানো, অপরকে বোঝার সহৃদয়তা। তাই মানুষের ভালো কাজের প্রশংসা করতে শেখাতে হবে, গায়ের রং-এর নয়।