নিজের খেলায় নিজেই ধরা সৌদি আরব?

সৌদি বাদশাহের রাশিয়া সফর মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত। ছবি: রয়টার্স
সৌদি বাদশাহের রাশিয়া সফর মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত। ছবি: রয়টার্স

সৌদি আরবের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি কি খাত বদল করল? গত সপ্তাহে সৌদি বাদশাহ সালমানের বিশাল বহর নিয়ে রাশিয়া সফর বা এ বছরের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশাল সামরিক চুক্তি অথবা মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে সামরিক জোট গঠন—এসবই সৌদি আরবের আঞ্চলিক নেতৃত্ব লাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব নিজস্ব ক্ষমতার অক্ষ তৈরি করায় আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে তারা পশ্চিমা শক্তির সমর্থনও পাচ্ছে। ইরান-তুরস্ক-সিরিয়ার অলিখিত জোটের বিপরীতে সৌদি আরবের নেতৃত্বে নয়া জোটের উত্থান পশ্চিমা শক্তিরও চাওয়া। পশ্চিমা শক্তিগুলো মনে করছে, এতে করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ভারসাম্য আসবে। সৌদি কূটনীতির সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোয় মিলছে তারই আভাস।

বাদশাহ সালমান ক্ষমতা লাভের পরপরই সৌদি পররাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তনে কাজ শুরু করেন, যা ‘সালমান ডকট্রিন’ নামে পরিচিত। শুরু থেকেই তিনি দীর্ঘদিনের রক্ষণাত্মক পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে গিয়ে আক্রমণাত্মক নীতির বাস্তবায়ন শুরু করেন। সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। চলতি বছর সৌদি আরবের সামরিক খাতে ব্যয় ৬ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে, যা পরিমাণে ৫০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ওয়াশিংটন পোস্টের হিসাব অনুসারে, সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে ২০১৬ সালে সৌদি আরব বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে ছিল।

সৌদি আরবের সমরাস্ত্র সংগ্রহের ধারা দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, বাদশাহ সালমান ‘সফট পাওয়ার’-এর বদলে ‘হার্ড পাওয়ার’-এর প্রয়োগেই বেশি আগ্রহী। যেমন তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের মাথায়ই সৌদি আরব ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা করে। যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কোনো অংশগ্রহণ ছাড়াই সৌদি নেতৃত্বে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) জোট ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত বাহিনীর বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে মার্চ থেকে লড়াই করছে। সালমান ডকট্রিনের মূল পরিকল্পনা হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরানের প্রভাব খর্ব করা। বৈরুত থেকে সানা পর্যন্ত ইরান অনুসারীদের শায়েস্তা করা। এ ছাড়া বিপরীত মেরুর অন্য দেশগুলোতে সরাসরি হামলা বা বিদ্রোহীদের উসকে দেওয়া এবং নিজস্ব বলয়ের দেশগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সামরিক সহায়তা দেওয়াও এই ডকট্রিনের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে।

ঝঞ্ঝাময় আরবে সিরিয়া ও ইরাকে জঙ্গিদের ক্রমাগত পিছু হঠা, স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের গণভোট ইত্যাকার বিষয় আমলে নিতে হবে সৌদি আরবকে। সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়কেই আস্থায় নিয়ে নিজের অবস্থান তৈরি করতে আগ্রহী। মনে রাখতে হবে, সৌদি-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক অংশীদারত্ব বেশ পুরোনো। চলতি বছরের মে মাসে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি সেই অংশীদারত্বের ধারাবাহিকতা। এই চুক্তির আওতায় সৌদি আরবে মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম শক্তিশালী করা হবে। আসবে অত্যাধুনিক সব মারণাস্ত্র। সৌদি আরব হয়তোবা বিশাল অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র ক্রয় করে রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে চেয়েছিল। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের আলোকে বলা যায়, সেদিক থেকে বাদশাহ সালমানের সফর খুব একটা সফল হয়নি।

সৌদি আরবের সামরিক উচ্চাভিলাষ আগে কখনো তেমনটা দেখা যায়নি। সৌদি আরবের এই সামরিকায়ন কেবল নিজের নিরাপত্তার খাতিরেই নয়। কার্যত কোনো দেশই সরাসরি সৌদি আরবের নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। তাহলে এখন তারা কেন সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করেছে? সৌদি আরবের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সেই জায়গা থেকেই বরাবরই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সৌদি আরবকে ইরানের বিরুদ্ধে উসকে দিতে চায়। কারণ, ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রধান হুমকি হচ্ছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রসমৃদ্ধ ইরান। ইরান থেকে সরাসরি ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সম্ভব। তাই সৌদি আরবকে ইরানের মুখোমুখি দাঁড় করানো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ছায়াযুদ্ধ বা প্রক্সি ওয়ার বলে একটি কৌশল অবলম্বন করে রাষ্ট্রগুলো। একই রকম আরেকটি কৌশল হচ্ছে ছায়া নিরাপত্তা বা প্রক্সি সিকিউরিটি। এ ক্ষেত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে অন্য কাউকে উসকে দিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কৌশল অবলম্বন করে রাষ্ট্রগুলো। আরবের রাজনীতিতে মিসর দীর্ঘ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের স্বার্থ দেখভাল করেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিসহ বিভিন্ন কারণে মিসরের প্রভাব এখন ম্রিয়মাণ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দরকার এমন এক নতুন মিত্র, যার মুসলিমদেশগুলোয় প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আছে। সৌদি আরব হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে কার্যকর বিকল্প। এখন সৌদি আরব মিসরের পরিবর্তে ইসরায়েলের ছায়া নিরাপত্তার কাজ করছে। যেখানে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইটা হওয়ার কথা ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে, সেটি এখন হচ্ছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের আড়ালে। বাদশাহ সালমান রাশিয়া সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে ইরান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ করেছেন। আলোচনার বড় একটি অংশজুড়ে ছিল ইরানকে যেন সহায়তা না দেওয়া হয়। ইরান ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠলে আরবের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে বলে বাদশাহ সালমান প্রেসিডেন্ট পুতিন বরাবর অভিযোগও করেছেন।

কিন্তু এত কৌশল অবলম্বন ও দৌড়ঝাঁপ করে কি ইতিবাচক কোনো ফায়দা হচ্ছে সৌদি আরবের? বিশেষজ্ঞরা কিন্তু তেমনটি মনে করছেন না। অনেকগুলা বিষয় সামলে নিয়ে সৌদি আরবকে আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার পথে এগোতে হবে। ইয়েমেনে দ্বন্দ্ব সংঘাত, ইরাক যুদ্ধ ও সিরিয়ার সংঘাত—এ তিনটি ঘটনায়ই সৌদি আরব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। তিন জায়গাতেই সৌদি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। আল-জাজিরার গবেষণা বিভাগের প্রধান থেসিমান ফাওকদা মনে করছেন, সৌদি আরব এসব করে ধীরে ধীরে উপসাগরীয় অঞ্চলে তার নিজের অবস্থানটিই হারিয়ে ফেলছে। বরং ইরান আরও শক্তিশালী হচ্ছে। সৌদি আরবের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই এখন সৌদি আরবের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। সিরিয়া ও ইরাকে ক্রমশ ভূমি হারানো আইএস যোদ্ধারা এখন কোথায় যাবে? সৌদি আরব জঙ্গিদের পরবর্তী চারণভূমি হয়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তখন সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বকে পাশে পাবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েই যায়। অনেক মুসলিম দেশ সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগ দিলেও এই বাদশাহি রাজত্বের ভাবমূর্তির সংকটে রয়েছে। ওয়াহাবিদের সমর্থন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গণতন্ত্রহীনতা এবং সিরিয়ায় সন্ত্রাসীদের প্রতি সমর্থনের অভিযোগ মুছে ফেলতে না পারলে সৌদি আরবের পক্ষে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সহজ হবে না।

বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে সৌদি আরব পরিস্থিতির শিকার হয়ে যায় কি না এবং নতুন অস্ত্রের বাজারে পরিণত হচ্ছে কি না, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। লক্ষণগুলো বলছে, নিজের খেলায় সৌদি শাসকেরা নিজেরাই ধরা খাচ্ছেন।

ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি কনসার্নস, জার্মানি।