কোন বিষয়ে নজর রাখা দরকার

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং

এ মাসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বোধগম্যভাবেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম জাতীয় কংগ্রেসে মনোযোগ নিবদ্ধ করেছে। অনুষ্ঠানটি চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে, যেখানে জানা যাবে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে কারা আছেন আর কারা নেই। সির প্রিয় মানুষ কারা, তা জানা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সম্মেলনটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, আমার কাছে ব্যাপারটা সে রকম মনে হচ্ছে না। এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দেশটির জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা সে অনুযায়ী কাজ করছে কি না।

২০১২ সালে দলটির কংগ্রেসের আগে সি দুই সপ্তাহের জন্য উধাও হয়ে গেলে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। এ বছর সে রকম কিছু ঘটলে সতর্কঘণ্টা বেজে উঠত। এ ছাড়া আগামী পাঁচ বছরের জন্য সি চিন পিং যে অ্যাজেন্ডা পেশ করবেন, তাতে যদি মনে হয় তিনিসহ দলের নেতারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছেন এবং জনগণের সঙ্গে দলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চুক্তি বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন, তাহলে এই ১৯তম কংগ্রেস খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। এ নিয়ে আমাদের খুব একটা সন্দিহান হওয়ার সুযোগ আছে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এ পর্যায়ে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে, বিশেষত দুটি প্রশ্ন। প্রথমত, চীন ভোক্তাদের সামান্য বৃদ্ধিতে কি ৬ থেকে ৭ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে পারবে? আর দ্বিতীয়ত, এখনো কিছুটা অনির্ধারিত বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ কি চীনা নেতৃত্বের মূল অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে? প্রথম প্রশ্নের প্রসঙ্গে বলা যায়, প্রবৃদ্ধির গতি ধীর থাকার পরও চীনের জিডিপিতে আরও প্রায় ১০ লাখ কোটি ডলার যুক্ত হবে। ফলে এ বছরের শেষ নাগাদ চীনের অর্থনীতির আকার হবে ১২০ লাখ কোটি ডলার, যেটা ২০১০ সালের দ্বিগুণ। এটাও ঠিক, ১২০ লাখ কোটি ডলার মার্কিন অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ। কিন্তু এ বছরে যে ১০ লাখ কোটি ডলার যুক্ত হবে, তা পৃথিবীর শীর্ষ ১৫টি অর্থনীতির মধ্যে সর্বোচ্চ। এটা ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কের সম্মিলিত মোট দেশজ উৎপাদনেরও বেশি, যেটা প্রায় মেক্সিকোর অর্থনীতির সমান।

সরকারি তথ্য অনুসারে চীনের মোট দেশজ উৎপাদনের ৩৯ দশমিক ২ শতাংশের জোগান আসে ব্যক্তিগত ভোগ থেকে। উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় এটা অনেক কম, যদিও ২০১০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হলে দেখা যাবে, ২০১০ সালের পর মোট দেশজ উৎপাদনে ২৫ লাখ ৮ হাজার কোটি ডলার যুক্ত হয়েছে। এটা ভারতীয় অর্থনীতির চেয়েও বড়। আর চীনে ভোগব্যয় বাড়াটা আজকের দিনে বৈশ্বিক ভোগ বাড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক।

২০২০ সাল পর্যন্ত যদি চীনের ভোগ বৃদ্ধির এমন মাঝারি হার বজায় থাকে, তাহলে সেটা মোট দেশজ উৎপাদনের ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। অর্থাৎ আরও প্রায় ২০ লাখ কোটি ডলার যুক্ত হবে। তবে কিছু অনির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায়, চীনের ভোগব্যয় এর চেয়েও দ্রুতগতিতে বাড়তে পারে। সে জন্য চীনের পর্যবেক্ষকদের কাছে সম্মেলনটা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ এখানে এমন কিছু ঘটে কি না, যার কারণে এই ধারা ব্যাহত হতে পারে। এই ধারা যদি ঊর্ধ্বমুখী থাকে, তাহলে চীনের ভোগব্যয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকে পৌঁছাতে পারে। সেটা খুবই ভালো লক্ষণ হবে। কারণ, এতে বোঝা যাবে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে পুনঃ ভারসাম্য আনাটা জরুরি ছিল, সেটা আসতে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় প্রশ্নের প্রসঙ্গে বলা যায়, আমার ধারণা, চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের পথেই থাকবে। বিশেষ করে, বাণিজ্য নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়ের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে। আমরা তো এই মহাপ্রকল্পের সুনির্দিষ্ট গতি-প্রকৃতি জানি না। তাই চীন ও ইউরোপের সঙ্গে উন্নততর অবকাঠামোর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংযোগ ঘটলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটা পরিষ্কার, চীনা ভোক্তারা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ ঠিক ততটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এর প্রভূত প্রভাব দেখা যেতে পারে। বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ ৬৫টি দেশের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলবে, যার মধ্যে চীন ও রাশিয়াও থাকবে। আর চীনের পর ১১টি জনবহুল দেশের মধ্যে ৯টি দেশ এই উদ্যোগের ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই আছে।

অধিকাংশ দেশই চীনের এভাবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিক উন্মোচন করতে পারেনি। অনেক দেশই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশ না নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সম্পদ বিনিয়োগ করে থাকে। কিন্তু এই উদ্যোগের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়তে পারে এবং কিছু দ্বন্দ্ব নিরসন করা সম্ভব হতে পারে। এতে এই অঞ্চলের মানুষের উন্নতি হবে। আবার এই বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অবকাঠামো প্রকল্পের চেয়ে এর ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক বেশি। এর মধ্য দিয়ে সূক্ষ্মভাবে চীনের সঙ্গে তার প্রতিবেশীদের সম্পর্কের উন্নয়ন হতে পারে। তবে ভারত ও উপমহাদেশের দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্কের বিশেষ গুরুত্ব আছে। সি যখন মে মাসে এই বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের প্রচারণা চালান, তখন সেই অনুষ্ঠানে মোদি উপস্থিত ছিলেন না। এতে সি বেশ বিরক্তই হয়েছিলেন। তবে সেপ্টেম্বরের ব্রিকস সম্মেলনে চীন ও ভারতের মধ্যে ভূমি নিয়ে দ্বন্দ্বের বেশ উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সমাধান হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যদি তাদের সমঝোতা–প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা যদি তাদের পথ অনুসরণ করে, তাহলে এই বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ বড় ধরনের নীতিগত উদ্যোগ হতে পারে।

তাই এই সম্মেলনে শুধু প্রাসাদ ষড়যন্ত্র নিয়ে বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। যে দুটি প্রসঙ্গ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে দুটি নিয়েই আলোচনা করলাম, অর্থাৎ চীনের ভোক্তা-চালিত প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে আর বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ পরিত্যক্ত হবে কি না—যেটা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার, মনে হচ্ছে না যে এর কোনো একটি ঘটবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

জিম ও’ নিল: যুক্তরাজ্যের সাবেক রাজস্বমন্ত্রী।