মার্কিন গণতন্ত্র: ছি ছি, এত্ত জঞ্জাল

গত মাসে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বাংলাদেশি সংগঠনের আমন্ত্রণে কথা বলতে এসেছিলেন উড্রো উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান। বাংলাদেশের চলতি গণতান্ত্রিক হালচালে অসন্তুষ্ট একদল বাংলাদেশি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিল, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমেরিকা তাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারে। মৃদু হেসে কুগেলম্যান জবাব দিলেন, ‘আমেরিকা তোমাদের সাহায্য করবে কি, এখন তো আমেরিকার গণতন্ত্র উদ্ধারে তার নিজেরই সাহায্য দরকার। আর যা-ই হোক, গণতন্ত্র উদ্ধারে আমেরিকার কাছে সাহায্য চাইতে এসো না।’ মুখে না বললেও আমাদের বুঝতে বাকি রইল না ভদ্রলোক ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে মার্কিন প্রশাসনের যে দুরবস্থা, সেদিকেই ইঙ্গিত করছিলেন।
প্রায় ৩০ লাখ ভোট কম পেয়েও ইলেক্টোরাল ভোটে এগিয়ে থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এ দেশের গণতন্ত্রের কাঠামোগত দুর্বলতার জন্যই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু শুধু ইলেক্টোরাল কলেজ নয়, মার্কিন গণতন্ত্রের আরও কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। তার একটি হলো এ দেশে যা ‘জেরিম্যান্ডারিং’ নামে পরিচিত, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন রয়েছে।
সহজভাবে বলতে গেলে, জেরিম্যান্ডারিংয়ের অর্থ হলো নির্বাচনী এলাকা এভাবে ভাগ করা, যাতে ক্ষমতাসীন দল বা ব্যক্তি সহজেই পুনর্নির্বাচিত হতে পারে। এ দেশে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করা হয় প্রতি ১০ বছর অন্তর, জাতীয় জনসংখ্যা গণনার ফল প্রকাশিত হওয়ার পরে। এই এলাকা নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করে রাজ্য পর্যায়ের আইন পরিষদ। যখন যে দল রাজ্য পর্যায়ে ক্ষমতাসীন, তারা নিজেদের স্বার্থ মাথায় রেখে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করতে উদ্যোগী হয়। রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের লক্ষ্য থাকে নির্বাচনী এলাকা এমনভাবে কাটাছেঁড়া করে সাজানো, যাতে নিজ দলের সমর্থক আছে, এমন লোকদের এক অভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় রেখে বিরোধীদের তার বাইরে ঠেলে দেওয়া।
মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে এখন যে মামলাটি উঠেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো জায়গায় এই নির্বাচনী এলাকা পুনর্নির্ধারণের কাজটি এমন অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে এখন আর ভোটাররা তাদের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচন করেন না, ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিরাই উল্টো ঠিক করে দেন কে তাঁদের ভোট দেবেন। বিচারকদের বিবেচ্য হচ্ছে অঙ্গরাজ্য উইসকনসিন। এখানে গত নির্বাচনে রিপাবলিকান দল পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৪৮ শতাংশ, অথচ আইনসভার ৬১ শতাংশ আসন তারা কবজা করে নেয়। এমন অসম্ভব সম্ভব হওয়ার পেছনের কারণ হলো অতিসফল জেরিম্যান্ডারিং। উইসকনসিনের রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত আইন পরিষদ নির্বাচনী এলাকাসমূহ এভাবে কাটাকুটি করে সাজায় যে পাশাপাশি না থাকা সত্ত্বেও সব রিপাবলিকান সমর্থকের ভোটের এলাকা পড়ে একই সীমানার ভেতর। যেসব ডেমোক্র্যাট সেসব এলাকার বাসিন্দা, তাদের কেটে এমনভাবে বাদ দেওয়া হয় যে পাশাপাশি বাড়ি সত্ত্বেও একজন রিপাবলিকান ভোট দিয়েছেন একই পাড়ার কোনো স্কুলে, আরেক ডেমোক্র্যাট ভোট দিয়েছেন তিন মাইল দূরের কোনো এক লাইব্রেরিতে, ভিন্ন নির্বাচনী এলাকায়। এই কাটাকুটির প্রধান লক্ষ্য, রিপাবলিকানরা যাতে তাঁদের সমর্থকদের সংখ্যাধিক্য না হারায়, অথবা ডেমোক্র্যাটরা কিছুতেই সংখ্যাধিক্য অর্জনে সক্ষম না হয়। একজন রিপাবলিকান সাংসদের বেলায় দেখা গেছে, তাঁর নিজের বাড়ির ঠিকানা ডেমোক্রেটিক নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হওয়ায় তাঁকে নির্বাচিত হতে সাহায্য করার জন্য শুধু তাঁর বাড়িটি আলাদা করে রিপাবলিকান এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পুরো ব্যাপারটা এত দৃষ্টিকটু ছিল যে গত বছর উইসকনসিনের একটি স্থানীয় আদালত নির্বাচনী এলাকার পুরো মানচিত্রকেই অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে রিপাবলিকান দল আপিল করলে সেটি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রে এই জেরিম্যান্ডারিংয়ের খেলাটা এখন রীতিমতো বৈজ্ঞানিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। কম্পিউটারের বদৌলতে এখন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব, যাতে প্রত্যেক ভোটারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যাবে। এ দেশে অধিকাংশ ভোটার কোন দলের সমর্থক, তা অজ্ঞাত নয়। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গত কয়েক নির্বাচনে কে কোন দলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তার তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। উইসকনসিনের বেলায় কম্পিউটারে এই তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে নিজেদের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ এমন একটি নির্বাচনী মানচিত্র এঁকে নিতে সক্ষম হয় রিপাবলিকানরা। এই কাজটি করার ভার দেওয়া হয়েছিল বিশেষজ্ঞ পরামর্শকদের ওপর। পরবর্তীকালে, সে মানচিত্র তৈরি হয়ে গেলে, ক্ষমতাসীন প্রত্যেক রিপাবলিকান সাংসদকে আলাদা করে ডেকে তা দেখিয়ে তাঁদের সম্মতি আদায় করে নেওয়া হয়।
এভাবে ভোটের ফলাফল যদি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আগেভাগেই ঠিক করে ফেলা হয়, তাহলে নির্বাচনের গণতান্ত্রিক মূল্য থাকে না। ভোট গ্রহণ হয়ে পড়ে প্রহসন। সে কারণে জেরিম্যান্ডারিং আসলে একধরনের ভোট ডাকাতি। নিজের পছন্দমতো নির্বাচনী এলাকা কাটাছেঁড়া করার এই প্রবণতা শুধু একা রিপাবলিকানদের নয়, ডেমোক্র্যাটদেরও রয়েছে। সমস্যা হলো, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ রাজ্য পর্যায়ের আইন পরিষদ এখন রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে। আইন পরিষদের উভয় কক্ষও গভর্নরের পদ, অর্থাৎ আইন ও নির্বাহী ক্ষমতা—উভয়ই রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে, এমন অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ২৪। অন্যদিকে আইন পরিষদ ও গভর্নর পদ ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে, এমন অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা মাত্র ৬।
ক্ষমতার সব চাবিই তাঁদের হাতে থাকায় রিপাবলিকান দলের এখন প্রধান লক্ষ্য ডেমোক্র্যাটদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন যেভাবে হোক ঠেকানো। এ কাজে জেরিম্যান্ডারিং একটি হাতিয়ার। অন্য আরেক হাতিয়ার হলো, ডেমোক্র্যাট সমর্থক ভোটারদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া। প্রথাগতভাবে আফ্রিকান-আমেরিকান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীসমূহ ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দিয়ে থাকে। এই সব ভোটারের অধিকাংশ আবার দরিদ্র। রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত একাধিক রাজ্যে চেষ্টা চলছে সংখ্যালঘুরা যাতে ভোটকেন্দ্রে না যেতে পারেন, তার নানা ফন্দিফিকির। যেমন উইসকনসিনে নতুন যে নির্বাচনী আইন করা হয়েছে, তাতে প্রত্যেক ভোটারকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য কোনো সরকারি পরিচয়পত্র, যেমন ড্রাইভিং লাইসেন্স, দেখাতে হবে। দরিদ্র অথবা বৃদ্ধ এমন মানুষের পক্ষে এই ধরনের পরিচয়পত্র সংগ্রহ খুব সহজ নয়। এর জন্য খরচের ব্যাপার আছে, সময়ের ব্যাপার আছে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিচয়পত্র সংগ্রহের বদলে অনেকে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকাই অধিক নিরাপদ মনে করেন। এক সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, শুধু এই ভোটার আইনের জন্য উইসকনসিনে কমপক্ষে ১৭ হাজার বৈধ ভোটার ভোটদান থেকে বিরত থাকেন।
রাজনীতি বরাবরই ক্ষমতার খেলা, তা আমেরিকাতেই হোক অথবা বাংলাদেশে। সবাই চায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে। কিন্তু সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বদলে ক্ষমতায় টিকে থাকার এই লড়াই যখন ভোট ডাকাতিতে পরিণত হয়, তখন পিছু হটে গণতন্ত্র, ফাঁকিতে পড়ে সাধারণ নাগরিক। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে এই ফাঁকি অপরিচিত অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু অগ্রসর গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা, যার বৈদেশিক নীতির অন্যতম ঘোষিত লক্ষ্য বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রসার, সেখানে যখন সেই একই কারচুপি দেখি, তখন বিস্মিত না হয়ে পারা
যায় না।
আমেরিকা বাংলাদেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণে সাহায্য করতে পারুক বা না পারুক, গণতন্ত্র এগিয়ে নিতে হলে কী করা উচিত নয়, অন্ততপক্ষে সেটুকু আমরা তার কাছ থেকে শিখতে পারি।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।