কলম ছেড়ে শাবল কেন?

শাবল মেহনতি মানুষের বেশ উপকারী হাতিয়ার। গ্রামগঞ্জে শক্ত ভিতের খুঁটি বসাতে এই জিনিস যে কী কাজ দেয়, তা না বললেও চলে। আর ঘরদোরে আটকে যাওয়া কোনো বেয়াড়া জিনিস বা জং ধরা কলকবজা খসাতে সেই শাবলের চাড়ই লাগে। এ তো গেল এই হাতিয়ারের উপকারের কথা। এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। চোর যখন রাতের আঁধারে গেরস্তের বাড়িতে সিঁধ কাটে, শাবল তখন আদিম অস্ত্র। এখানেও অবশ্য উপকারের বিষয় আছে—তবে তা চোরের দিক থেকে।

প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও প্রতীকী শাবল আমরা দেখতে পাই পদে পদে। প্রযুক্তির যত উৎকর্ষ, সবই মানবকল্যাণে—এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এক মুঠোফোন যন্ত্রেই যে কত অ্যাপ মোলায়েম করে দিচ্ছে জীবনধারা, বলে শেষ করা যাবে না। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো আরেক কাঠি সরেস—হাতের মুঠোয় এনে দিচ্ছে গোটা বিশ্ব। কোথায় কী হলো, সব খবর চলে আসছে ম্যাজিকের মতো। কিন্তু এতে যখন প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটনা ঘটে, তখনই ওই শাবলের ঘা!

দেশের সংবাদপত্রগুলোর আজ শনিবারের প্রথম পাতার টাটকা খবর—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘটনা। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, গতকাল শুক্রবার সকালে অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষার প্রশ্ন আগের রাতেই ই-মেইল, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের কাছে চলে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি অস্বীকার করেনি। তারা বলছে, পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) কার্ডসদৃশ একটি যন্ত্র দিয়ে কেন্দ্রের বাইরে থেকে উত্তর সরবরাহ করা হয়েছে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের দুই নেতাসহ ১৫ জনকে আটক করা হয়েছে। অভিযোগের মধ্যে থাকা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা মহিউদ্দিন রানাকে এর মধ্যে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। আধুনিক প্রযুক্তির কারিগরি কৌশল প্রয়োগে বারবারই এমনটি ঘটছে। জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিতে তো প্রতিবছরই এমন অভিযোগ শোনা যায়। কোনোটার প্রমাণ মেলে, কোনোটার প্রমাণ চাক্ষুষ করা যায় না।

যেকোনো বিষয় ফাঁস হওয়ার মধ্যে একধরনের উত্তেজনা থাকে। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ তাঁর উইকিলিকসের তেলেসমাতি দেখিয়ে কী কাণ্ডটাই না ঘটিয়েছিলেন! একের পর এক ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল মার্কিন গোপন নথি, আর তা নিয়ে সারা বিশ্বে কী যে আলোড়ন! প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার মধ্যে যেহেতু পরীক্ষার্থীদের নগদে দাঁও মারার সুযোগ রয়েছে, এ জন্যই এ ব্যাপারে তাদের এত আগ্রহ। কিছু শিক্ষার্থী যেন উন্মুখ—প্রশ্নের হাঁড়িটা শিকে থেকে পড়ে কখন ফাটবে! আর তখন কলমটা ছুড়ে ফেলে শাবল নিয়ে বসে যাবে তারা। তখন তারা কাছা মারা শ্রীমান সিঁধেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা গা খুবলে কলঙ্কের কালো গর্ত করে ভেতরে সেঁধিয়ে পড়তে চালাতে থাকবে শাবল।

কিন্তু কলম থাকতে বারবার এই শাবল চালানোর ধান্দা কেন? কলম কিন্তু সবাই ধরতে পারে না, শাবল মারতে মোটামুটি সবাই পারে। আমাদের মেধার জোর যদি না থাকে, কলম যদি ভোঁতা হয়ে আসে, তাহলে পড়াশোনা করে কী লাভ? শিক্ষা-দীক্ষায় কী হবে? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য একেকজনের কাছে একেক রকম। একজন খেটে খাওয়া দিনমজুরের কাছে পড়াশোনা অনেকটা বিলাসিতার মতো। তিনি ভাবেন, বিদ্যায় কী হবে? ছেলেটা যদি গায়ে-গতরে খাটার মতো যোগ্যতা বেশি রাখে, তাহলে দুটো ভাত জোগাতে পারবে। আর মেয়েটা তো কোনোমতে বিয়ে দিতে পারলেই ল্যাঠা যায়। মালদার গড়পড়তা মহাজনও মেয়ের বিদ্যালাভ নিয়ে ভাবেন না। তাঁরা ভাবেন, ছেলেটা বাণিজ্য চালানোর মতো হিসাব-কিতাব জানলেই হলো, এত্ত এত্ত পাস দিয়ে কী হবে!

তবে সমাজের বড় একটা অংশই কিন্তু সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে আকাঙ্ক্ষী ও তৎপর। ছেলেমেয়ে শিক্ষিত হয়ে দেশের কাজে আসবে, দশের কাছে সম্মান কুড়াবে, এ প্রত্যাশা যতই থাক না কেন, আসল লক্ষ্য থাকে সন্তানের জীবন-জীবিকার উন্নত সোপান। যেখানে কায়ক্লেশ নেই, অর্থকষ্ট নেই। এ জন্য প্রত্যেক অভিভাবকই চান, সন্তান একটি ভালো বিষয় নিয়ে একটি ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুক। এ জন্য চাই ভালো ফল। সে এক দৌড় বটে! আজকাল নগর বা শহুরে জীবনে সন্তানকে কেবল স্কুল বা কলেজে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হন না অভিভাবক, এর বাইরে একাধিক প্রাইভেট টিউটরও রাখেন। কোচিং সেন্টারে পাঠান। ১৮ অক্টোবর ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, শিক্ষার্থীরা আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় কেবল হাজিরা দিতে, পাঠ নেওয়া চলে কোচিং সেন্টারে। এখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে ভালো ফল। কোচিংয়ের দিকে কেবল শিক্ষার্থীরই যে ঝোঁক, তা নয়। অনেক অভিভাবকও এতে আগ্রহী।

অভিভাবকদের মধ্যে একটা দল বলছে, স্কুল-কলেজে আজকাল সেভাবে পড়াশোনা হয় না, তাই কোচিং। আরেকটা দল দ্বিমত পোষণ করে বলছে, ব্যাপারটি আসলে সে রকম নয়। সন্তানের ফল যাতে আরও ভালো হয়, এ জন্যই কোচিং। দেখা যায়, শিশু থেকে তরুণ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানির্ভর। এতে হচ্ছেটা কী? রোজ রোজ স্কুল-কলেজের পড়া তো আছেই, এর বাইরে সকাল-বিকেল ছুটতে হচ্ছে কোচিংয়ে। শিক্ষার্থীর সঙ্গে অভিভাবক, বিশেষ করে মায়েরা ছুটে ছুটে হয়রান। অনেক ক্ষেত্রেই এসব শিক্ষার্থীর অবসর বা নিজের মতো করে কিছু করার সময় থাকছে না। মজার কোনো খেলা খেলবে, একটি সুখপাঠ্য বই পড়বে, মনের মতো রঙে ছবি আঁকবে—সময় বা সুযোগ নেই। এই ব্যস্ততা কিন্তু কখনোই ছাড়ে না। এতে পাঠ্যবইয়ের সীমাবদ্ধতার বাইরে অনেক বিষয়ই থাকে অজানা। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় ‘আউট নলেজের’ ঘাটতি তাকে আটকে দেয়। রবীন্দ্রনাথের দুটো কাব্যগ্রন্থের নাম লিখতে গেলে মাথায় ঘাম ছুটে যায়। দেখা যায়, গোল্ডেন জিপিএ-৫ও ধরা খেয়ে গেছে। এ জন্য মেধাবী দুর্দম অনেক সময় গাল বাঁকা করা অকর্মা নন্দদুলাল বনে যায়। এসব নন্দদুলালের জন্যই ‘ওরা’ প্রশ্ন ফাঁস দুপয়সা কামিয়ে নেওয়ার ধান্দা করে।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]