পুষ্টি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি

পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অপুষ্টির শিকার জনগোষ্ঠী দিয়ে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। বেশি জোর দিতে হবে নারী ও কিশোরীদের পুষ্টির উন্নতিতে। অপুষ্টি দূর করতে হলে সঠিক খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। একই সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, দেশের মানুষের পুষ্টির উন্নতি করতে হলে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়াতে হবে।

গতকাল সোমবার প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত ‘নারী ও কিশোরীদের জন্য পুষ্টি খাতে বিনিয়োগ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তাঁরা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। পুষ্টিবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল এই বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করে। এতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সাংসদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুষ্টিবিদ, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, গবেষক ও এনজিও কর্মীরা অংশ নেন।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বর্তমান সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্টিকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেন। কারণ, এই সরকার জানে, পুষ্টিসমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী ছাড়া দেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। তবে এ ক্ষেত্রে বড় বাধা বাজেটের স্বল্পতা। তিনি বলেন, ‘মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে আমাদের সফলতা আছে। কিন্তু স্বীকার করি, পুষ্টিতে আমরা পিছিয়ে আছি। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে।’ পুষ্টি তথা স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর ব্যাপারে গণমাধ্যমকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, সরকার ইতিমধ্যে
প্রতিটি জেলায় একজন করে পুষ্টিবিদ নিয়োগ দিয়েছে।

সাংসদ সিমিন হোসেন আলোচনার শুরুতে বলেন, নির্বাচনী এলাকায় পুষ্টি খাতে ব্যয় করার জন্য সাংসদের কাছে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় না। তিনি বলেন, বয়স ১৮ বছরের কম থাকতেই ৫৯ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়ে যায়। এঁদের অধিকাংশের পুষ্টির ঘাটতি থাকে। সাংসদ, নীতিনির্ধারক, গবেষক, শিক্ষক সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অপুষ্টি দূর করার ব্যাপারে কথা বলতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে। তিনি বলেন, তিনি নিজ উদ্যোগে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের দুপুরে টিফিনের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর মতে পুষ্টি বিনিয়োগ হচ্ছে ‘স্মার্ট’ বিনিয়োগ।

নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর জাকী হাসান বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও পুষ্টির উন্নতি—এ বিষয় দুটি একে অন্যের পরিপূরক। তিনি বলেন, পুষ্টির উন্নতিতে আর্থিক বিনিয়োগই একমাত্র জরুরি বিষয় নয়। পুষ্টির ব্যাপারে সময় দেওয়া, মনোযোগ দেওয়া—এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগের বিষয় হতে পারে।

এরপর নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে একটি উপস্থাপনার মাধ্যমে দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, দেশে পুষ্টির উন্নতিতে সরকার ও অংশীদারদের মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্সেসের পরিচালক নাজমা শাহীন বলেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেই অপুষ্টি দূর হয় না। মানুষ কোন উপাদান কোন খাদ্য থেকে পাচ্ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের জাতীয় পুষ্টিনীতির আলোকে জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। এখন দরকার এর সফল বাস্তবায়ন। এ জন্য জাতীয় পুষ্টি পরিষদের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার বলেন, নারীর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য অধিদপ্তর একাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রথম প্রসব বিলম্বিত করার দিশারি প্রকল্প। এটি কার্যকর প্রমাণিত হলে তা সারা দেশে বিস্তার ঘটানো হবে।

অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মুজহারুল ইসলাম বলেন, জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মপরিকল্পনায় মোট ২৫ উপাদান বা কম্পোনেন্ট আছে। এর প্রথম চারটি পুষ্টি খাতে বিনিয়োগ-সম্পর্কিত। আগামী পাঁচ বছরে কর্মপরিকল্পনায় ৭২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দকে তিনি যথেষ্ট বলে উল্লেখ করেন।

কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জোয়েল স্পাইসার বলেন, ১৩ বা ১৫ বছর বয়সে যে কিশোরীর বিয়ের পর সন্তান হয়, সেই কিশোরীর কোনো আশা থাকে না। কিশোরী সন্তানের আশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকে। তিনি বলেন, পুষ্টির জন্য অর্থ ব্যয় করাই যথেষ্ট নয়, সেই অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে, সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

একই প্রতিষ্ঠানের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এন্ড্রু এ কনেল বলেন, দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার ১৫টি মন্ত্রণালয়কে যুক্ত থাকার কথা বলেছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলো কী কাজ করেছে, তা পর্যবেক্ষণ করা দরকার।

 বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, পুষ্টিতে বৈষম্য আছে। এ ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে। সার্বিকভাবে অপুষ্টি দূর করতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি পুষ্টি বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো দরকার।

আলোচনায় অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সহযোগী বিজ্ঞানী সাবরিনা রশিদ বলেন, পুষ্টির সঙ্গে জড়িত জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। অন্যদিকে সম্পদ যা আছে তা ব্যবহারে নজরদারি বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, একই কর্মসূচি দেশের সব অঞ্চলে বা সব মানুষের জন্য কার্যকরী না-ও হতে পরে। এসব ক্ষেত্রে কাজের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা দরকার।

ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির প্রধান মাহফুজা রিফাত বলেন, কিশোরীরা ঝুঁকির মুখে। পুষ্টি খাতে জনবলের স্বল্পতা আছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যালাইভ অ্যান্ড থ্রাইভের কান্ট্রি ডিরেক্টর জেবা মাহমুদ বলেন, এ দেশের সংস্কৃতির কারণে অন্যের চোখে ভালো থাকার জন্য মেয়েরা অনেক কিছু ত্যাগ করে। যেমন কম খায়, কম বিশ্রাম নেয়। ভালো হতে গিয়ে সে নিজেকে বঞ্চিত করে। এ ক্ষেত্রে বাবা বা ভাই বা স্বামী তাকে সহায়তা করতে পারে। তাদের একটু সহায়তা নারীর পুষ্টিতে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা খালেদা খাতুন বলেন, পুষ্টির ভিতটা শৈশবে গড়ে তোলা দরকার। তিনি পাঠ্যপুস্তকে পুষ্টির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন।