সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্বাধীনতা বনাম জাতীয় নিরাপত্তা

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, জাতীয় নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের সম্পর্ক বেশ জটিল ও পুরোনো। আমরা যদি জার্মান তাত্ত্বিক ইয়ুর্গেন হাবেরমাসের ‘পাবলিক স্ফিয়ার’ বা সামাজিক পরিসরের ধারণা মানি, তাহলে বলা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সমাজ বা রাষ্ট্রকে বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা সেই নগর রাষ্ট্রের আমল থেকেই ছিল। হাবেরমাস বলেছেন, পাবলিক স্ফিয়ার এমন স্থান, যেখানে জনসাধারণ তাদের ধ্যানধারণা নিয়ে জড়ো হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করে। আজ হয়তোবা সামাজিক যোগাযোগের ভার্চ্যুয়াল এক জগৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু প্রাচীন গ্রিক বা রোমান নগর রাষ্ট্রগুলোতেও পানশালা, সরাইখানা বা জনসাধারণের বিভিন্ন সংযোগস্থলের মতো সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম আমরা দেখতে পাই। ওই প্রাচীন সময়ের তথ্য সংগ্রহের ও আদান-প্রদানের নমুনা বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারি, গ্রেকো-পার্সিয়ান যুদ্ধের বিবরণ হেরোডেটাস রচনা করেন তৎকালীন ওই সব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই। অথবা বলা যায়, সক্রেটিস তাঁর দর্শন ছড়িয়ে দেওয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই বেছে নিয়েছিলেন অ্যাথেন্স নগরে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, সেই প্রাচীন অ্যাথেন্স থেকে হাল আমল পর্যন্ত অভিজাত শাসক সম্প্রদায় বরাবরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিশাল শক্তিকে ভয় পেয়েছেন। এবং জাতীয় নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের সংহতির কথা বলে একে খর্ব করতে চেয়েছেন। সেটা প্রকাশ্য কোনো জনসমাগম হোক বা হালের ভার্চ্যুয়াল জগৎই হোক।

ইন্টারনেটভিত্তিক এই যুগে প্রতিনিয়তই রাষ্ট্র নাগরিকের ই-মেইল, ফেসবুক বা টুইটারে আড়ি পাতছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জেনে নিচ্ছে ই-মেইল বা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাগরিকের পাঠানো তথ্যের খুঁটিনাটি। এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যে জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং তাদের সহযোগী দেশগুলো প্রযুক্তি ব্যবহার করে জেনে নিচ্ছে নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনের তথ্য। শুধু জনসাধারণই নয়, ভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বও নজরদারির শিকার হচ্ছেন হরহামেশাই। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের টেলিফোনেও আড়ি পেতেছিল মার্কিন গোয়েন্দারা। ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপক প্রসারের কারণে জাতীয় নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পারস্পরিক সম্পর্ক ও এর সীমারেখা নিয়ে পশ্চিমা সমাজে বিতর্ক হচ্ছে। বিতর্কের মূল বিষয় হচ্ছে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাগরিকদের ওপর নজরদারি মানবাধিকারের লঙ্ঘন কি না? বা তা করলেও কতুটুক করা যাবে। কারণ, জাতীয় নিরাপত্তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

যাঁরা আড়ি পাতছেন বা যাঁরা আড়ি পাতার শিকার হচ্ছেন, দুই পক্ষেরই প্রখর যুক্তি আছে। প্রথমত, রাষ্ট্রব্যবস্থার পত্তন থেকে বলা হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই সন্দেহভাজনদের ওপর নজরদারি করা হয়। একেবারে শুরুর দিকে সন্দেহভাজন ছিল শোষিত শ্রেণি। যারা রাষ্ট্রকাঠামোতে অভিজাতদের ক্ষমতা খর্ব করতে চাইত। এখন সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের যুগ। বলা হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জঙ্গি, সন্ত্রাসীদের তথ্য সংগ্রহের জন্যই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, রাষ্ট্রীয় এসব কার্যকলাপ বোধকরি খারাপ কিছু নয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে সন্ত্রাসীদের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাধারণ নাগরিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন কি না? রাষ্ট্রের এসব যুক্তির বিপরীতে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ জাতীয় নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস দমনের কথা বলে মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাক্‌স্বাধীনতাকে হরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, কুকর্মকে আড়াল করা।

স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যের আলোকে বলা যায়, বর্তমানে অনেক দেশের নাগরিকেরাই একধরনের গণ-নজরদারির মধ্যে আছে। জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে নাগরিকের ব্যক্তিগত সব তথ্য যেমন টেলিফোনে কথোপকথনের ইতিহাস, মুঠোফোন নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা, ইন্টারনেট ব্যবহারের ধরন, এমনকি ক্রেডিট কার্ডের তথ্যও রাষ্ট্র সংগ্রহ করছে পূর্বানুমতি ছাড়াই। অজান্তেই ইন্টারনেটের জগৎ থেকে নাগরিকের চিন্তা, কল্পনা ও কথোপকথন জেনে নিচ্ছে রাষ্ট্রশক্তি। এই তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে বৈধতাদানের জন্য বিভিন্ন দেশে আইনও প্রণয়ন করা হচ্ছে যেমন ব্রিটেনের ‘দ্য ইউকে ইনভেস্টিগেটরি পাওয়ার অ্যাক্ট-২০১৬’। বিভিন্ন দেশে এ রকম নানা ধরনের আইন আছে, যে আইনের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো রাষ্ট্রকে তথ্য সরবরাহ করছে। গুগল বা ফেসবুক তাদের সদস্যদের তথ্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রকে দিয়েছে বলে জানা যায়।

আগেই বলেছি, জাতীয় নিরাপত্তা রাষ্ট্র পরিচালনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য জেনে নেওয়া রাষ্ট্রের জন্য খারাপ কিছু নয় বা এটি রাষ্ট্রের নেতিবাচক চরিত্রও নয়। জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন ভারতের পণ্ডিত কৌটিল্যও আজ থেকে প্রায় ২ হাজার ৩০০ বছর আগেই বলে গিয়েছিলেন, নিজ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শত্রু রাষ্ট্র ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ছদ্মবেশী গোয়েন্দা পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে। কিন্তু তাই বলে আইন করে গণহারে নজরদারি করা কতটুকু নীতিসম্মত? আইনের অপব্যবহারের বিষয়টিও ধর্তব্যের মধ্যে রাখতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জাতীয় নিরাপত্তার কতটা ক্ষতি করা যেতে পারে? নিরাপত্তার কথা বলে উত্তর কোরিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তান, সুদান বিভিন্ন সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়াসহ ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব বন্ধ করে রেখেছিল। উল্লেখ্য, এসব দেশে কিন্তু সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নেই। কর্তৃত্বপরায়ণ, একনায়কতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক ও সীমিত গণতন্ত্র উল্লিখিত দেশগুলোয় রয়েছে। এমন নয় যে ওই দেশগুলোয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেই জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যাবে। বরং এদের অনেকের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠীকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ আছে। বাস্তবতা হচ্ছে, একটি দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও স্বচ্ছ শাসনকাঠামো থাকলে সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রয়োজন নেই। তাই খেয়াল রাখতে হবে, জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন কায়েমের আড়ালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে কি না।

এটিই অধিকার বিষয় সংগঠনগুলোর উদ্বেগের মূল কারণ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবারই অভিযোগ করে আসছে, এভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে মানবাধিকারের লঙ্ঘন করা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। সাইবার সিকিউরিটি বা জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে ব্যক্তির নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাকেই হরণ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের দায়িত্বই হচ্ছে অনলাইন বা অফলাইন সর্বক্ষেত্রেই নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এবং সেটা নাগরিকের স্বাধীনতা খর্ব না করেই। এ বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয় ২০১৪ ও ২০১৬ সালের রেজল্যুশনও যথেষ্ট নয়। কারণ, এই রেজল্যুশন রাষ্ট্রগুলোকে বাধা দিতে পারছে না।

গত এক দশকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে রীতি বিস্ফোরণ ঘটেছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কৌশলে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো ফেসবুক, টুইটার ব্যবহার করে সদস্য সংগ্রহ করছে। তাদের মতবাদ প্রচার করছে বা তাদের সর্বশেষ সন্ত্রাসী কার্যকলাপ তুলে ধরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গুজব ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা যেমন আছে আবার রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের তথ্য প্রকাশ করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি চরিত্রই আছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নেওয়া, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও মানবাধিকার বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্র ও মানবাধিকার কর্মী সবাইকে একসঙ্গেই কাজ করতে হবে। নতুনবা স্নোডেনের মতো কেউ না কেউ রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য বাইরে নিয়ে আসতেই থাকবেন। এতে রাষ্ট্র বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে এবং রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নাগরিকদের আস্থা কমে আসবে।

ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি কনসার্নস, জার্মানি