ইসলামে আনন্দ-বিনোদন

মানবজীবনের প্রথম সমস্যা হলো নিঃসঙ্গতা। হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে যখন জান্নাতে রাখা হলো, তখন তিনি একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতার সমস্যায় পড়েন। তাঁর এই সমস্যা সমাধানে আল্লাহ তাআলা হজরত হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। শুরু হয় মানবসভ্যতার যৌথ পথচলা। মানুষ সামাজিক জীব, তাই সে নিঃসঙ্গ বা একাকী জীবন ধারণ করতে পারে না।

নিষ্পাপ আনন্দ ও বৈধ বিনোদন সুন্নত। বিনোদনের উপায়-উপকরণগুলোর প্রায় সব কটিই প্রিয় নবীজি (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম প্রয়োগ ও উপভোগ করেছেন। যেমন গল্প, কৌতুক, হাস্যরস, খেলাধুলা, কবিতা আবৃত্তি, পদ্য প্রণয়ন, গদ্যপাঠ, সাহিত্যরচনা, সংগীত ইত্যাদি।

আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) কুস্তি লড়েছেন। তৎকালীন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বীরকে তিনি তিন-তিনবার হারিয়েছেন। মদিনায় যুবকদের শারীরিক কসরত তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন। হজরত আয়েশাও (রা.) ঘরে বসে তা উপভোগ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিবি আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে একাধিকবার দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন।

শৈশবে নবীজি (সা.) খেলাধুলায় নেতৃত্ব দিতেন। কৈশোরে হুজুরে পাক (সা.) প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করতেন। তরুণ বয়সে তিনি তরুণ সংঘ গড়ে তোলেন। যুবক বয়সে তিনি সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর রচিত কবিতা বুখারি শরিফসহ সিহাহ সিত্তাহ ও অন্যান্য হাদিসগ্রন্থে উল্লেখ আছে। যেমন ‘আনা নাবিউন লা কাযিব, আনা ইবনু আবদিল মুত্তালিব।’ অর্থ: আমি নবী মিথ্যা নই, আমি আবদুল মুত্তালিবের পুত্র হই। (সিরাতে ইবনে হিশাম)।

নবীজি (সা.) কাব্য পছন্দ করতেন। হজরত হাসসান ইবনে সাবিত (রা.) ভালো কবিতা রচনা করতেন এবং চমৎকার আবৃত্তি করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জন্য মদিনা শরিফে মসজিদে নববিতে আরেকটি মিম্বর বানিয়ে দিলেন, যেখান থেকে তিনি তাঁর কাব্য উপস্থাপন করতেন। প্রিয় নবীজি (সা.) কাব্যপ্রেমী ও ভালো শ্রোতাও ছিলেন। তিনি হজরত হাসসান (রা.)-এর কবিতায় মুগ্ধ হয়ে নিজের গায়ের উত্তরীয় তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

নবীপত্নীগণসহ বহু নারী সাহাবিও কবিতা ও সাহিত্য রচনা করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। যেমন ‘লানা শামছুন ওয়া লিল আফাকি শামছুন; ওয়া শামছি আফদালুশ শামছি ছামায়ি। ফা ইন্নাশ শামছা তাৎলাউ বাদাল ফাজর; ওয়া শামছি তাৎলাউ বাদাল ইশায়ি।’ অর্থাৎ আমার আছে সূর্য, দিগন্তেও আছে সূর্য; আমার সূর্যটি আকাশের সূর্য হতে শ্রেষ্ঠ। দিগন্তে সূর্য ওঠে ফজরের পরে; আমার সূর্য উদিত হয় ইশার অন্তরে। (সিরাতে ইবনে ইসহাক, জজবায়ে মারেফাত)।

আনন্দ-বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো সংগীত। প্রিয় নবীজি (সা.) প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে যখন মদিনায় গেলেন, তখন দীর্ঘ দুই সপ্তাহের অবিরাম সফরের ক্লান্তিতে মলিন বদনে এক উষালগ্নে যখন সেখানে পৌঁছান, তখন মদিনার ছোট্ট ছেলেমেয়েরা অভ্যর্থনাসংগীত গেয়ে প্রিয় নবীজি (সা.)-কে স্বাগত জানাল। তারই দুটি চরণ হলো ‘তলাআল বাদরু আলাইনা মিন ছানিয়াতিল বেদায়ে, ওয়াজাবাশ শুকরু আলাইনা মা দাআ লিল্লাহি দায়ি।’ অর্থ: সানিয়া বেদা হতে পূর্ণিমা শশী উদয় হলো আমাদের প্রতি; কৃতজ্ঞতা কর্তব্য আমাদের ডেকেছেন তিনি আল্লাহর প্রতি। (ইসলামি বিশ্বকোষ)।

যুদ্ধজয়ের পর বালিকারা নবীজি (সা.)-কে দফ (বিশেষ বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে গান গেয়ে বরণ করত। একবার নবীজি (সা.) সফরে থাকা অবস্থায় হজরত আয়েশা (রা.) এক দাসীকে বিয়ে দিলেন। নবীজি (সা.) সফর থেকে ফিরে এসে জানতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন: তার বিয়েতে কি আনন্দ অনুষ্ঠান করেছ? হজরত আয়েশা (রা.) বললেন, না। নবীজি (সা.) বললেন, কেন করোনি? (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

বৈরাগ্য বা নির্জনবাস তথা নিঃসঙ্গ ইবাদত ইসলামে বিধেয় নয়। সিদ্ধ নয় বিরামহীন উপবাস বা রোজাও, যা হজরত দাউদ (আ.)-এর নিকট শত বকরির (নিরানব্বই ও এক ছাগল) কাহিনি দ্বারা পবিত্র কোরআনে বিবৃত হয়েছে। (সুরা ৩৮: ছোয়াদ, আয়াত: ২১-২৬)। হাদিস শরিফে এসেছে: ‘তোমরা এই দিবসগুলোতে রোজা রেখো না; কারণ, এই দিনগুলো হলো পানাহার ও খেলাধুলার জন্য।’ (তিরমিজি শরিফ, আল জুমাল)।

কোরআন অর্থ পাঠ করা বা পাঠযোগ্য। কিরাআত ও তিলাওয়াত তথা আবৃত্তি ও পরিবেশনা নবীগণের (আ.) অন্যতম দায়িত্ব। কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ শব্দটি হলো ‘ইকরা’, মানে পড়ো। পড়া, পাঠ, শ্রবণ ও পড়ে শোনানো এবং সাহিত্য প্রতিযোগিতা বিশেষ সুন্নত। কোরআন করিমের তিন আয়াতবিশিষ্ট সর্বকনিষ্ঠ সুরা ‘আল কাউসার’ অবতীর্ণ হওয়ার পর তা বিখ্যাত সাবআহ মুআল্লাকাহর (সপ্ত ঝুলন্ত গীতিকা) পাশে কাবাগাত্রে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা দেখে তখনকার আরবের প্রধান কবি লাবিদ মন্তব্য করেছিলেন: ‘লাইছা হাজা মিন কালামিল বাশার’ (ইহা মনুষ্য বাণী নহে)। অতঃপর লাবিদসহ অনেক কবি-সাহিত্যিক ইসলাম গ্রহণ করেন। (সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া)।

হাস্যরসবোধ মানুষের জন্মগত। হাস্যরসের অন্যতম উপায় হলো কৌতুক। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) হাজারো দুঃখ-কষ্টেও হাস্যরস ও কৌতুক করেছেন। একদা নবীজি (সা.) কয়েকজন সাহাবিসহ খেজুর খাচ্ছিলেন। প্রত্যেকে খেজুরের বিচি যাঁর যাঁর সামনে রাখছিলেন। নবীজি (সা.) তাঁর খেজুরের বিচি হজরত আলী (রা.)-এর সামনে (তাঁর খেজুরের বিচির সঙ্গে) রাখতে লাগলেন। খেজুর খাওয়া শেষ হলে দেখা গেল, সবার সামনে প্রায় সমপরিমাণ খেজুরের বিচি; কিন্তু হজরত আলী (রা.)-এর সামনে দ্বিগুণ খেজুরের বিচি এবং নবীজি (সা.)-এর সামনে কোনো বিচিই নেই। এবার নবীজি (সা.) বললেন, আলী! তুমি তো দ্বিগুণ খেজুর খেয়েছ। হজরত আলী (রা.) সপ্রতিভ বললেন, আমি হয়তো খেজুর বেশি খেয়েছি; কিন্তু খেজুরের বিচি খাইনি; আপনি তো খেজুরের বিচিসহই খেয়ে ফেলেছেন। (নবী সা. জীবন)।

সহাস্য বদনে থাকা ও হাসিমুখে কথা বলা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে থাকতেন। হাদিস শরিফে রয়েছে: ‘কোনো মুসলমানের সঙ্গে দেখা হলে হাসিমুখে কথা বলা সদকা করার সমান সওয়াব।’ অর্থাৎ দানে যেমন পুণ্য হয় ও আত্মা পবিত্র হয় এবং প্রশান্তি লাভ করে; অনুরূপ হাসি দ্বারা পুণ্য অর্জন হয়, মন পরিষ্কার হয় ও শান্তি লাভ হয়। (শামায়েলে তিরমিজি শরিফ)।

ইসলাম মানুষের সুকুমারবৃত্তির ইতিবাচক বিকাশ ও কল্যাণকর প্রকাশ চায়, যা তার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। এমন কোনো আনন্দ বা বিনোদন বিধেয় নয়, যা অদূর ভবিষ্যতে বা সুদূর ভবিষ্যতে তার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, দেশ ও জাতির জন্য অমঙ্গলের কারণ হবে। ইসলামে বিনোদনের ক্ষেত্রে যে বিষয় লক্ষ রাখা হয় তা হলো, কল্যাণকর ও প্রশান্তিদায়ক হতে হবে। এমন আনন্দ নয়, যা পরিণতিতে বেদনার কারণ বা উপলক্ষ হবে। জ্ঞানচর্চা সর্বোত্তম বিনোদন।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।