নিজেদের খবর প্রথম পাতায় ছাপতে হবে

গড়ে প্রতি পাঁচ দিনে একজন সাংবাদিক পৃথিবীর কোথাও না কোথাও শুধু সাংবাদিক হওয়ার জন্য খুন হচ্ছেন। ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টিরই বিচার হয় না। এতে যে বিচারহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়, তা কেবল মৃত্যুর হুমকি ও সহিংসতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সাংবাদিকদের কারান্তরীণ করার হার এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কাজের সময় সাংবাদিকদের নিয়মিতভাবে হয়রানি ও ভয় দেখানো হয়। আজ পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় সাংবাদিকতা বিপজ্জনক পেশার অন্যতম। ব্যাপারটা আমলে নেওয়ার একটি উপায় হচ্ছে এ নিয়ে কথা বলা। সংবাদ প্রতিবেদন করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা কী ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েন, সেটা তিনটি ঘটনা দিয়ে বোঝা যায়। সে জন্যই বোঝা যায়, এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য তাদের দুর্দশার কথা রাষ্ট্র করাটা পরিবর্তনের একমাত্র মাধ্যম।

ফিলিপাইনের অনলাইন সংবাদ পোর্টাল র‍্যাপলার ডট কমের প্রধান নির্বাহী মারিয়া রেসার কথাই ভাবুন। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই ওয়েবসাইট দেশটির প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধে’ সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড-সংক্রান্ত খবরের আকড় হয়ে ওঠে। উদ্যোগী প্রতিবেদনের জন্য রেসা শুধু গত মাসেই ৮০টির বেশি হত্যার হুমকি পেয়েছেন। এই হুমকির অনেকগুলোই এসেছে অপরিচিত ব্লগারদের কাছ থেকে, যেগুলোর আইপি ঠিকানা দেখে মনে হয়, এরা প্রেসিডেন্টের সাঙ্গাত।
এরপর উইলিয়াম এনতিজের কথা বলা যায়। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইওয়েরি মুসেভেনির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ হচ্ছে, তিনি সেই ঘটনাবলির ওপর প্রতিবেদন করেছেন। যদিও সংবিধান অনুসারে ইওয়েরি সেটা পারেন না। তো সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তিনি পুলিশের বেদম পিটুনির শিকার হন এবং তাঁকে ১০ দিনের বেশি সময় কারাগারে রাখা হয়।

শেষমেশ মিয়ানমারেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যেন ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। দেশটির গণমাধ্যম আইনের নতুন সংশোধনী অনুসারে নাগরিকদের কোনো সংবাদ প্রতিবেদন ও কলাম সম্পর্কে আপত্তি থাকলে মামলা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, এমনকি তাতে যদি সরাসরি তাদের উল্লেখ না-ও থাকে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতির একদম বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও আইনের এই বিধানের বদৌলতে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর ৬১টি মামলা হয়েছে, অর্থাৎ অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ক্ষমতায় আসার পর থেকে।
একনায়কতান্ত্রিক শাসনে তুরস্ক থেকে রাশিয়া বা তারও পরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার এরূপ লঙ্ঘন সাধারণ কৌশলে পরিণত হয়েছে। শুধু স্বৈরাচার বা বলশালী শাসকেরা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি; কলম্বিয়া ও মেক্সিকোর শত শত সাংবাদিককে অপরাধীদের চক্রের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী দেওয়া হয়েছে। এসব সত্ত্বেও লাতিন আমেরিকার সাংবাদিকদের দলে দলে পেশা ত্যাগ করা বন্ধ করা যায়নি। মেক্সিকোর মাদক চক্র আবার সংবাদের শিরোনাম থেকে দূরে থাকার জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সন্তানদের হুমকি দেয়। গণমাধ্যমের ভূমিকা যে সংকুচিত হচ্ছে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

সংবাদ পাঠকদের সিংহভাগই যে এসব খবর জানেন না, তার কারণ হলো আমার প্রতিষ্ঠানের মতো আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে যে সাংবাদিকেরা যেন কখনো খবরের শিরোনাম না হন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষপাতীরা সাধারণত এই ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করেছেন যে তথ্যভিত্তিক ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার সবচেয়ে মোক্ষম উপায় হচ্ছে তাঁদের সহিংসতার হাত থেকে দূরে রাখা। আর সিংহভাগ সাংবাদিকের মতো আমরা নীরবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অর্থাৎ এই পেশা কতটা বিপজ্জনক, আমরা সেসব বলে পাঠককে ভারাক্রান্ত না করার অবস্থান নিয়েছি। কিন্তু এখন মনোভঙ্গি বদলানোর সময় এসেছে। এই পেশার ঝুঁকি কেমন, সেটা এখন জোরেশোরে বলার সময় এসেছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফ্রি প্রেস আনলিমিটেডের জরুরি তহবিলের টাকায় রিপোর্টার্স রেসপন্ড গোষ্ঠীর নিয়োজিত আইনজীবীরা যথেষ্ট চেষ্টাচরিত্র করার পর এনতিজে ছাড়া পান। ২০১১ সালে এই তহবিল গঠিত হওয়ার পর কয়েক ডজন সাংবাদিককে সহযোগিতা করা হয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি বুরুন্ডির সহিংসতা এড়িয়ে পালানোর সময় অনেক সাংবাদিককে সহযোগিতা করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক সংগঠন মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপসহ বিভিন্ন জায়গার দুর্দশাগ্রস্ত সাংবাদিকদের অর্থসাহায্য দিয়ে থাকে। হ্যাঁ, এসব কথা বলা স্রেফ শুরু।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষপাতীদের কাজ হবে সাংবাদিকদের অধিকতর শক্তিশালী ও সমন্বিত কাঠামো দেওয়া, যাতে তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। সেই লক্ষ্যে আমাদের সংগঠন অন্যান্য বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইউএন প্ল্যান অব অ্যাকশন অন দ্য সেফটি অব জার্নালিস্ট অ্যান্ড দ্য ইস্যু অব ইমপিউনিটি সংহত করতে চাইছে। ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়নে অন্যান্য গণমাধ্যম গোষ্ঠীর সঙ্গে আমরা নিয়মিত বৈঠক করছি। আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে যাতে গণমাধ্যমের নিরাপত্তা দেওয়া হয়, আমরা সেটা নিশ্চিত করারও চেষ্টা করছি।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটা গণমাধ্যমের ভেতর থেকে আসা উচিত। কারণ সাংবাদিকের নিরাপত্তার ব্যাপারটা গণমাধ্যমের কর্মী, দর্শক ও ফ্রিল্যান্সারদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এই সংগঠনগুলোর উচিত, এসব বিষয়ে প্রতিবেদন করা। গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের হার বাড়তে থাকায় সেই পুরোনো গর্বিত নীরবতার নীতি আর কার্যকর নয়। সাংবাদিকেরা যদি নিজেদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে মানুষকে তাঁদের বিপদ সম্পর্কে জানান, তাহলে পৃথিবীকে তা শুনতে হবে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে সহিংসতার ব্যাপারটা ঐতিহাসিকভাবেই সংবাদ শিরোনাম হয়নি। গতকালের দিনটিকে পৃথিবী ইন্টারন্যাশনাল ডে টু অ্যান্ড ইমপিউনিটি ফর ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট জার্নালিস্টস স্বীকৃতি দিয়েছে, আসুন, এবার এসব ঘটনাকে প্রথম পাতায় ছাপানোর অঙ্গীকার করি।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

লিও উইলেমস: ফ্রি প্রেস আনলিমিটেডের পরিচালক।