বাংলাদেশের সবার কাছ থেকে আমি ভালোবাসা পেয়ে আসছি

প্রণব মুখার্জি
প্রণব মুখার্জি
আগামী জানুয়ারিতে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশে আসার কথা। তাঁর জন্য বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে রয়েছে এক অনন্য আসন। সম্পর্কের এই রসায়ন বিশ্লেষণের পাশাপাশি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, রোহিঙ্গা সমস্যা, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বললেন ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথম আলো: জানুয়ারি মাসে আপনি যাওয়ার আগে থেকেই যদি রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর পর্ব শুরু হয়ে যায় খুব ভালো হয় তাহলে।

প্রণব মুখার্জি: একেবারে আচমকাই এই বিপুল বোঝাটা বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসল। খুব দুর্ভাগ্যজনক। দেশের অর্থনীতি একটা স্টেডি গ্রোথের মধ্য দিয়ে চলছে। হুট করে এই পাহাড়প্রমাণ সমস্যা।

প্রথম আলো: সমাধান কী?

প্রণব মুখার্জি: সমাধান তো একটাই। মিয়ানমারকে সব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো সমাধান কি থাকতে পারে? সে জন্য মিয়ানমার সরকারকে রাজি করাতে হবে। আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় গিয়ে যা বলে এসেছেন সেটাই উপায়। ভিটেমাটি ছেড়ে যারা চলে আসতে বাধ্য হয়েছে, তাদের ফেরত নিতে হবে। তাদের মনে আস্থা ফেরাতে হবে। ত্রাণ, অর্থ সাহায্য এসব সাময়িক। বেশি দিন চলতে পারে না। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নীতি আছে। অসম্প্রীতি ও বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। অবিশ্বাস আছে। কাজটা তাই কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়।

প্রথম আলো: সু চির আচরণ কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

প্রণব মুখার্জি: গণতন্ত্রের জন্য সু চি দীর্ঘ লড়াই করেছেন। সেই সংগ্রাম, তাঁর ত্যাগ অনস্বীকার্য। তোমাকে মিয়ানমারের সমাজকে বুঝতে হবে। ইতিহাস দেখতে হবে। সে দেশে বহু জনগোষ্ঠী রয়েছে। গণতন্ত্র ধীরে ধীরে এগোতে চাইছে। সবাইকে নিয়ে চলতে পারেনি। সামরিক শাসন তাই প্রাধান্য পেয়েছে। কারও সমালোচনা করার আগে তাই সার্বিক প্রেক্ষাপট বিচার করা প্রয়োজন। সু চির আগে উ নু ছিলেন। তারপর নে উইন। কেউই মূল সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। এ অবস্থায় সন্ত্রাসী মনোভাবের মাথাচাড়া দেওয়ার প্রবণতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সমাধানের জন্য তাই সবকিছু বিবেচনায় রাখতে হবে। তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়াই একমাত্র সমাধান।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নানা টানাপোড়েনের পর আজ অনেকটা থিতু হয়েছে। পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরতা বেড়েছে। বাংলাদেশ আজ ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশ
ী। এই সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা বড় অনুঘটকের কাজ করেছে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন।

প্রণব মুখার্জি: অবশ্যই। তবে আরও অনেক কারণ আছে।

প্রথম আলো: অবশ্যই আছে। কিন্তু আমার প্রশ্নটা আলাদা। এই স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের সব কাজ এগিয়ে এনেও চুক্তি সই করার ক্ষেত্রে বিজেপি বেঁকে বসেছিল। আপনাদের সরকারকে সেই কৃতিত্ব নিতে দেয়নি। অথচ তারা ক্ষমতায় আসার পর কাজটা করে ফেলল। এই রাজনীতি আপনাকে কষ্ট দিয়েছিল?

প্রণব মুখার্জি: চুক্তিটা তো শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী সেই ১৯৭৪ সালে সই করেছিলেন। কিন্তু তারপর অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। শেখ মুজিব নিহত হলেন। টালমাটাল হলো। দুই দেশের কারও সেভাবে চুক্তিটা বাস্তবায়িত করার তাগিদ ছিল না সমস্যাটার সমাধান করার। বেরুবাড়ী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর একটু আলোড়ন হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশে ওটা যে খুব একটা বড় রাজনৈতিক সমস্যা ছিল তা নয়। যদিও বাংলাদেশে সেটা ছিল বড় বিষয়। মনমোহন সিংয়ের সময় এটার দিকে নজর দেওয়া হয়। কিন্তু হলো না।

প্রথম আলো: রাজনীতিটাই বড় হলো।

প্রণব মুখার্জি: যা ন্যায্য সেখানে দলীয় অবস্থানকে সব সময় গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। দলীয় অবস্থান যদি নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, তাহলে আইনসভায় আমি কোথায় বসছি, স্পিকারের ডান দিকে না বাঁ দিকে, সরকারি দলে না বিরোধী দলে, সেটা বড় জিনিস হয় না। আমার এত বছরের রাজনীতিতে আমি দলীয় অবস্থানকে কখনো নীতির ঊর্ধ্বে স্থান দিইনি। এটা আমি বিশ্বাস করি বলেই বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে যখন ডব্লিউটিও চুক্তি ১৯৯৪ সালে সই করেছিলাম, সেটা লোকসভায় পাস হলো কিন্তু রাজ্যসভায় পাস করাতে পারলাম না। দুবার ব্যর্থ হলাম। বিজেপি, সিপিআই (এম) সব এক হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে অর্ডিন্যান্স জারি করতে হয়। কারণ, চুক্তিটা কার্যকর করার কথা ’৯৫ সাল থেকে। বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী, মুরাসলি মারান তখন বাণিজ্যমন্ত্রী। সমস্যাটা এল তখন। ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ এল, ভারত কথা দিয়েও কথা রাখেনি। তাদের দেশে পেটেন্ট আইন তারা চালু করেনি। যত ধাপ ছিল আবেদন করার, প্রতিটিতেই ভারত হেরে গেছে। তাই ভারতকে ডব্লিউটিও থেকে বের করে দেওয়া হোক। এই সময় রাস্তা ছিল দুটো। হয় পেটেন্ট আইন পাস করাতে হবে, নতুবা ভারতকে বের করে দেওয়া হবে। রাজ্যসভায় কংগ্রেস চাইলে বামদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিলটা আটকে দিতে পারত। তখন বাজপেয়ি কথা বলেন মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে। মনমোহন তাঁকে বলেন, আমার সঙ্গে আলোচনা করতে। বাজপেয়ি বলেন, আমরা তো ওঁর আইনটাই করতে চাইছি। আমি কথা বলি সোনিয়াজির সঙ্গে। সোনিয়া বললেন, পার্টিকে বোঝাতে হবে। আপনি বোঝান। আমি তখন সংসদীয় দলের বৈঠক ডেকে গোটা বিষয়টা বোঝালাম। বললাম, যে আইন আমরা নয়-দশ বছরে পাস করাতে পারিনি, আর বাজপেয়ি সরকার যা পাস করাতে চাইছে তাতে দুটি পার্থক্য আছে। প্রথম পার্থক্য, আমার আইনটা ছিল ১৯৯৫ সালের। বিলের তারিখ ছিল সেটা। আর এই বিলের তারিখ হলো ২০০৩। দ্বিতীয় পার্থক্য, পুরোনো বিলে বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে আমার নাম লেখা ছিল, নতুন বিলে থাকছে মুরাসলি মারানের নাম। বাকি হুবহু এক। শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। বিলটা রাজ্যসভায় পাস হয়ে গেল। এটা বললাম এই কারণে, মৌলিক নীতিটা এক থাকা দরকার।

প্রথম আলো: স্থলসীমান্ত চুক্তিতে তা হয়নি। কষ্ট দিয়েছিল কি না তাই জানতে চেয়েছিলাম।

প্রণব মুখার্জি: স্বাভাবিকভাবেই আমার খারাপ লেগেছিল। আমাদের আমলেই এটা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়নি। কী করা যাবে।

প্রথম আলো: রাজনীতিতে এই যে মৌলিক নীতির কথা বললেন, তিস্তার ক্ষেত্রে কি সেটা প্রযোজ্য হলো?

প্রণব মুখার্জি: সেটা নির্ভর করবে সেই সময়কার সরকারের ওপর। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটা মৌলিক নীতি গ্রহণ করেছিলাম। তা হলো আমরা রাজ্যের কথা শুনব কিন্তু রাজ্যকে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা দেব না। তাহলে পররাষ্ট্রনীতি চালিয়ে যাওয়া ভারতের পক্ষে অসুবিধা হবে। আমাদের দেশের সংবিধান এই ক্ষমতা সরকারকে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেটা দেওয়া হচ্ছে। প্র্যাকটিস করা হচ্ছে। কেন, আমার পক্ষে সেটা বলা সম্ভব নয়। তা নির্ভর করে সম্পূর্ণভাবে সেই সময়ের সরকারের ওপর।

প্রথম আলো: চুক্তি না হলে নিম্ন অববাহিকার দেশগুলোর অধিকারের কী হবে?

প্রণব মুখার্জি: চুক্তি না করতে পারলে তারা আন্তর্জাতিক সালিসিতে যাবে।

প্রথম আলো: এ নিয়ে আপনার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কখনো কোনো আলোচনা হয়েছে?

প্রণব মুখার্জি: মন্ত্রী হিসেবে বা রাষ্ট্রপতি হিসেবে কার সঙ্গে কী কথা হয়েছে তা আমি বাইরে বলি না। বলা উচিত নয়।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের এই দাবি সম্পর্কে আপনার মত কী?

প্রণব মুখার্জি: আমি ভ্যালু জাজমেন্ট করতে পারি না। তা হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে তুমি করোনি কেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলে, অর্থমন্ত্রী ছিলে, ক্যাবিনেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলে, রাষ্ট্রপতি ছিলে। তাহলে করোনি কেন? কাজেই সেখানে আমার ভূমিকা কী ছিল, কী বলেছিলাম তা প্রকাশ করা যাবে না।

প্রথম আলো: তিস্তা হবে কি হবে না ভবিষ্যতের কথা। এখন দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর অববাহিকার যৌথ ব্যবস্থাপনার দাবি উঠতে শুরু করেছে।

প্রণব মুখার্জি: এটা একটা বিরাট বিষয়। আগামী দিনে নদীর জলের প্রবাহ বিরাট বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এর সঙ্গে পরিবেশ জড়িয়ে আছে। জলের পরিমাণ কতটা তা জড়িয়ে আছে। ফারাক্কা বাঁধ যখন প্রথম তৈরি হয় তখন যে পরিমাণ জল ফারাক্কা বাঁধে ধরে রাখা যাবে বলে মনে করা হয়েছিল, আজ তার চেয়ে অনেক কম জল আছে। ওপর থেকে জল টেনে নেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগও আছে। আবার প্রধান উৎস থেকে জল কম আসছে, হিমবাহ গলে যাচ্ছে, অনেক সমস্যা আছে। কাজেই এই সমস্যাগুলোর একটা আন্তর্জাতিক নীতি বা রীতি (নর্ম) তৈরি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এটা যে দেশগুলো করবে তারা ওই অনুযায়ী চলবে। কিন্তু দু-তিনটে দেশ যে এটা করতে পারবেই তেমন মনে করার কোনো কারণ নেই। আমরা নিজেদের দেশের রাজ্যগুলোর মধ্যেই বিবাদ মেটাতে পারছি না। কৃষ্ণা, কাবেরী, নর্মদার জল ভাগাভাগির বিবাদ এখনো অব্যাহত। আর এটা তো অন্য একটা রাষ্ট্র। একমাত্র উপায় পারস্পরিক আলোচনা ও দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা। কিন্তু কে কী দেবে ও কে কী ছাড়বে এ নিয়ে আমি এখন কিছু বলতে পারব না।

প্রথম আলো: এমন নয় যে বাংলাদেশে আপনাদের আদি বাড়ি ছিল। কর্মজীবনে বহুবার আপনি বাংলাদেশে গেছেন এমনও নয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই দেশটার মানুষজনের সঙ্গে আপনার একটা চমৎকার সখ্য গড়ে উঠেছে। প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আপনার জন্য একটা বিশেষ আসন পাতা আছে। আমি এই কবছরে দেখেছি, যখনই কেউ না কেউ কোনো না কোনো কাজে এ দেশে এসেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা না করে দেশে ফেরেননি। এই বিশেষ স্থান অর্জন কীভাবে সম্ভব হলো?

প্রণব মুখার্জি: এটা তুমি খুব সত্যি একটা কথা বললে। বাংলাদেশের সবার কাছ থেকে বরাবর আমি খুব শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা পেয়ে আসছি। এটা আমার সৌভাগ্য। ওঁরা আমাকে নিজেদের বলে মনে করেন।

প্রথম আলো: এই সৌভাগ্য খুব কম মানুষের রয়েছে। অকৃপণ ভালোবাসা পাচ্ছেন।

প্রণব মুখার্জি: এই যে অকৃপণ ভালোবাসার কথাটা বললে না, সত্যিই আমাকে ওঁরা হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসেছেন। একটা ঘটনা বলি। ২০০৪ সালে জঙ্গিপুর থেকে লোকসভার ভোটে দাঁড়ানোর জন্য অধীর চৌধুরী খুব চাপাচাপি করছিল। আমাদের দেশের খবরের কাগজগুলোয় তা নিয়ে ছোটখাটো কিছু লেখালেখি হচ্ছিল। আমাদের শারদ পাওয়ার সেই সময় কোনো একটা কাজে বাংলাদেশ গিয়েছিলেন। ফিরে এসে বললেন, আমাকে নিয়ে ওখানে ব্যাপক হইচই। সর্বত্র আলোচনা আমি ভোটে দাঁড়াচ্ছি কি না। যেন ওটাই হবে একটা মেজর ইভেন্ট। আমি জানি না, আমি এটা ডিজার্ভ করি কি না। কিন্তু কীভাবে যে ওঁরা আমাকে ভালোবাসেন কী বলব।

[আগামীকাল শেষ পর্ব]