মার্কিন গোপন নথিতে ৭ নভেম্বরের পূর্বাপর

৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ পরবর্তী সেনা বিদ্রোহগুলোতেও ভূমিকা রেখেছে
৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ পরবর্তী সেনা বিদ্রোহগুলোতেও ভূমিকা রেখেছে

আজ ৭ নভেম্বর। বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশিদ-খন্দকার মোশতাক চক্রের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এক সেনা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল খালেদ মোশাররফ। সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করেন তিনি। অন্যদিকে কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর সিপাহিদের সহায়তায় জিয়াউর রহমানকে নিয়ে বিপ্লবের (রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল) প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

ওই প্রেক্ষাপটে ৭ নভেম্বর বিদ্রোহী সিপাহিরা অফিসারদের হত্যা করে জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন। বিএনপির কাছে এটা ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’, আওয়ামী লীগের কাছে তা ‘অফিসার হত্যা দিবস’। এরপর নাটকীয়ভাবে জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। বলা হয়ে থাকে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ১৮ থেকে ২২টি ক্যু হয়েছে। দেশের ইতিহাসের এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অধ্যায়গুলো নিয়ে কোনো রাষ্ট্রীয় তদন্ত বা সরকারি নথিবদ্ধকরণ হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শী সেনা কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন লেখকের বই, নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে উল্লিখিত বিদ্রোহের বিবরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

তবে সম্প্রতি অবমুক্ত করা কিছু মার্কিন নথি নতুন করে সাক্ষ্য হাজির করেছে যে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের রেশ তার দুই বছর পরের সেনা বিদ্রোহেও চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে।

প্রাপ্ত নতুন নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়া সেনানিবাস এবং ২ অক্টোবর ঢাকা সেনানিবাসে ‘বিদ্রোহ’ হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের বগুড়া বিদ্রোহ গত ৩০ সেপ্টেম্বরে চার দশক পূর্ণ করেছে। এদিন একদল সিপাহি কতিপয় অফিসারকে হত্যা করেছিল। ওই সময়ে তারা বগুড়ায় সেনানিবাসের একাংশ দখল করেও নিয়েছিল। বগুড়া শহরেও কিছু গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। ঢাকার বিদ্রোহে সিপাহিরা জড়িত হলেও তা মূলত সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোর ও বিমানবাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নৌবাহিনী ছিল শান্ত, নিস্তরঙ্গ।

তবারক হোসেন ওই সময়ে পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড ই মাস্টার্স ৪ অক্টোবর ১৯৭৭ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ওয়াশিংটনে একটি গোপন তারবার্তা পাঠান। এতে দেখা যায়, জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রশাসনের ধারণা ছিল, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলির সঙ্গে দুই বছর পরে সংঘটিত ওই দুটি বিদ্রোহের যোগসূত্র ছিল। ঢাকার বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এ এফ এম আহসান উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি হয়েছিল। কিন্তু সেই কমিটির রিপোর্ট কখনো আলোর মুখ দেখেনি।

তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাস্টার্স আরও লিখেছেন, তবারক হোসেন মনে করেন, সাম্প্রতিক সেনা বিদ্রোহ প্রধানত দুটি কারণে ঘটেছে। প্রথমত, ১৯৭৬ সালের জুলাইয়ে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির বিরুদ্ধে সিপাহিদের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ এবং তাহেরের একাধিক সহযোগী তখন পর্যন্ত জেলে ছিলেন। দ্বিতীয়ত, সিপাহিদের চেয়ে অফিসারদের বেতন-ভাতা দশ গুণের বেশি ছিল। আর জাসদ এই ক্ষোভটাই কাজে লাগিয়েছে। উল্লেখ্য, কর্নেল তাহের পঁচাত্তরের নভেম্বরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে সিপাহিদের মধ্যে এই বঞ্চনার ক্ষোভকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন।

তবে এটা লক্ষণীয় যে নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে সংঘটিত দুটি বিদ্রোহে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এম এ মঞ্জুর ভারতের সংশ্লিষ্টতা চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁরা এ বিষয়ে অভিন্ন ধারণা দিয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাস্টার্সকে।

তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল মঞ্জুর ১২ অক্টোবর মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেছিলেন, বগুড়া ও ঢাকার বিদ্রোহে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের উপাদান দ্বারা প্রভাবিত মনে হয়। কারণ, কোনো অভ্যন্তরীণ শক্তি কেবল নিজের শক্তিতে বিদ্রোহ করতে যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। আবার বাইরের শক্তি অভ্যন্তরীণ উপাদান দ্বারা উৎসাহিত না হলে একা কিছু করতে পারে না।

মঞ্জুরের কথায়, জাসদ এই বিদ্রোহের অভিন্ন সুতো। কিন্তু তাদের পেছনে বাইরের শক্তি কে, সে বিষয়ে ভিন্নতা রয়েছে। এ পর্যায়ে মাস্টার্স লিখেছেন, বগুড়ার ঘটনায় মনে হচ্ছে এই উসকানি বামপন্থী জাসদের দিক থেকে এবং বাইরের থেকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তরফে এসেছে। তবে আমি যখন ভারতের বিষয়ে জানতে চাইলাম, তখন মঞ্জুরের কথায়, ‘জিজ্ঞাসাবাদে স্পষ্ট যে বগুড়ার বিদ্রোহে ভারতের হাত রয়েছে। তবে সেটা ভারতীয় সরকারের নীতির প্রতিফলন হিসেবে না-ও হতে পারে।’

উল্লেখ্য, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় জাসদের উত্থান, বিশেষ করে ৭ নভেম্বর এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে জাসদের সম্পৃক্ততা আজও গবেষকদের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হয়ে আছে। আবার বগুড়া বিদ্রোহের অল্প আগে বিদেশ থেকে ফারুক রহমান এসেছিলেন। এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট ছিল যে ফারুককে বগুড়ায় পাঠানো উচিত হবে না। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করা হয়। সার্বিকভাবে মাস্টার্সের মতে, বগুড়ার ঘটনায় ডানপন্থীরা উৎসাহিত হয়েছিল। কারণ, ঢাকায় সিপাহিরা প্রকাশ্যে কারাবন্দী খন্দকার মোশতাকের মুক্তি দাবি করে স্লোগান দিয়েছিল।

জিয়ার ধারণা ছিল জাসদ ভারতের তৈরি, জাসদ যা নাকচ করে থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিখেছেন, ‘আমি জেনারেল মঞ্জুরকে বললাম, বগুড়ার ঘটনায় জাসদ ও ভারতের মধ্যে একধরনের অদ্ভুত সখ্যের ছায়া দেখা যায়। এ কথা শুনে মঞ্জুর বললেন, জাসদ মুজিবের আমলে শক্তিশালী ছিল। ওই সময়ে ভারত হয়তো জাসদের কারও কারও ওপর বিনিয়োগ (মেইড ইনভেস্টমেন্টস) করেছিল।’ তিনি বলেন, সিরাজুল আলম খান ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে কলকাতায় গিয়েছিলেন। এবং সেখানে তিনি সমর্থন পেয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। ভারতীয়রা হয়তো এ থেকে কিছু ফায়দা নিয়েছে। মঞ্জুর নিশ্চিত করেন, ‘জিয়ার প্রতি অনুগত নবম ডিভিশনের পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনী বিদ্রোহ ব্যর্থ করে দিয়েছে। আর এই বিদ্রোহ নিশ্চিতভাবেই জিয়াকে উৎখাতের জন্য করা হয়েছিল।’

ওই সময় সিরাজুল আলম খান, মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব কারাগারে ছিলেন। তাহেরের মামলায় তাঁদেরও বিচার হয়েছিল। তবে ১৯৭৫ সালের পর ১৯৭৭ সালের অক্টোবরেও ধারণা করা হচ্ছিল যে তাদের পুনরায় বিচার হতে পারে। তবে কী কারণে তা পরিষ্কার ছিল না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন, সিরাজুল আলম খানকে আইনি সহায়তা দিতে লন্ডন থেকে আইনজীবী জোয়ন্না ডডসন এসেছিলেন।

মঞ্জুর মাস্টার্সকে তাঁর ওই বক্তব্য ১৯৭৭ সালের ১৩ অক্টোবর দিয়েছিলেন। এর পাঁচ দিন পর জেনারেল জিয়া সেনা বিদ্রোহের দিকে ইঙ্গিত করে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতা হলে তা শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, তা ভারতের জন্যও সমস্যা। ব্রিটেনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে বৈঠকের বরাতে জিয়া বলেন, দেশাই একজন সৎ মানুষ। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি উত্তম ধারণা পোষণ করেন। কিন্তু ভারতে এমন মহল রয়েছে, যারা এই সম্পর্কে একটা ঝামেলা বাধিয়ে রাখতে চায়।

২৩ নভেম্বর ১৯৭৭ জিয়া ও খালেদা জিয়া মাস্টার্স ও তাঁর স্ত্রীকে সেনানিবাসের বাড়িতে এক বিদায়ী নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। এদিন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘তিনি সাম্প্রতিক বিদ্রোহে ভারতীয় সরকার না হলেও ভারতের কোনো মহলের সংশ্লিষ্টতার একটা আভাস পেয়েছেন। জিয়ার কথায়, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা ভারতের জন্য ‘‘নিজের পায়ে কুড়াল মারার” শামিল।’

৪০ বছর আগের নভেম্বরে বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে ‘কয়েক হাজার রাজনৈতিক বন্দী’ ছিল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ২৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনকে লিখেছেন, ‘আমি তাদের মুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করি।’ এ সময় জেনারেল জিয়া কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে অন্তরীণ থাকা ব্যক্তির সংখ্যা ‘কয়েক শ’ উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, ১৯৭৫ থেকে তিনি প্রায় ছয় হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিয়েছিলেন।

আমরা মনে করি, প্রকৃত সত্য জানতে সব ধূসর অধ্যায়ের ওপর কাজ হওয়া উচিত। জেনারেল জিয়াউর রহমান উল্লিখিত দুটি বিদ্রোহের তদন্ত করা ও তার ফলাফল প্রকাশের অঙ্গীকার করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের ১৮ অক্টোবর মাস্টার্স অপর এক তারবার্তায় বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এ এফ এম আহসান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান আল মামুন এবং সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানেরা কমিটিতে থাকবেন। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মনোনীত যুগ্ম সচিব থাকবেন এর সদস্যসচিব। আমরা আজ পর্যন্ত নির্দিষ্টভাবে কতগুলো সেনা বিদ্রোহ ও তাতে কত লোকের প্রাণ গেছে, তা জানতে পারিনি। আমরা এটা জানতে চাই।

লেখক-গবেষক মেজর (অব.) এ এস এম শামছুল আরেফিনের সঙ্গে গতকাল আলাপ করি। তিনি বলেন, ‘বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরী কাজ শুরু করেছিলেন জানতাম। বিদ্রোহের কারণে বগুড়ায় ২২ বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিলুপ্ত করা হয়েছিল। আমাদের জানামতে ওই রিপোর্ট কখনো প্রকাশ করা হয়নি।’

আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর সরকারি নথিপত্র ধ্বংস করার একটি আদেশ দিয়েছিলেন। তখন প্রচুর নথিপত্র পোড়ানো হয়। কী কী নথিপত্র পোড়ানো হয়েছিল, তা-ও কি জানার দরকার কেউ মনে করেন না? এ ধরনের বিদেশি নথিপত্রের সত্যতা তাহলে আমরা কী দিয়ে যাচাই করব?

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷