উন্নয়ন প্রকল্প 'তাজমহল' নয়

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

সংবাদপত্রসমূহে প্রায়ই মেগা প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নে বিলম্বের খবর দেখা যায়। আবার কোনো কোনো সময় প্রকল্প নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। মেগা প্রকল্পসংক্রান্ত এ বিষয়গুলো কেবল বাংলাদেশেই নয়, বরং পৃথিবীর সর্বত্রই আলোচ্য বিষয়। মেগা শব্দের অর্থ মিলিয়ন বা ১০ লাখ। মেগা প্রকল্প অর্থ সাধারণভাবে মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। মেগা প্রকল্পের ব্যয় মূল্যস্ফীতির কারণে এখন গিগা অর্থাৎ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে টেরা অর্থ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি ডলার ছুঁতে চলেছে। এতত্সত্ত্বেও, গিগা কিংবা টেরা প্রকল্প নয়, বরং মেগা প্রকল্প কথাটিই প্রচলিত।
ব্যয়বহুলতা ছাড়াও মেগা প্রকল্প বৃহদাকার, কারিগরিভাবে জটিল ও এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লাগে। এ ধরনের প্রকল্পে সরকার ও বেসরকারি খাতের নানা অংশীদার থাকে এবং সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে এ ধরনের প্রকল্প জনগণের জীবনযাত্রা ও মানে মৌলিক পরিবর্তন সাধন করে থাকে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর এ ধরনের মেগা প্রকল্পের বাজার প্রায় ৬-৯ লাখ কোটি ডলারের মতো।
মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনেক সময় কারিগরি মহিমা (টেকনোলজিক্যাল সাবলাইম) জড়িত হয়ে পড়ে। মেগা প্রকল্পে প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদেরা তাঁদের জ্ঞানের সীমাকে অতিক্রমের সম্ভাবনা দেখতে পান। সবচেয়ে বড় সেতু, উঁচু ভবন, জটিল তথ্যপ্রযুক্তি, বড় ও দ্রুতগতির ট্রেনের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বপ্ন এঁদের বিভোর করে রাখে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেন্ট ফ্লাইভজার্গ কারিগরি মহিমার সঙ্গে আরও তিনটি, যথা: রাজনৈতিক মহিমা (পদ্মা সেতু—বিশ্বব্যাংক ছাড়া আমরাও পারি), অর্থনৈতিক মহিমা (সুয়েজ খাল—অর্থায়নে নয় বছর সময় লেগেছিল) ও নন্দনতাত্ত্বিক মহিমা (সিডনি অপেরা হাউস) যোগ করেছেন। বিশ্বব্যাপী ১০৪টি দেশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন যে প্রতি ১০টি মেগা প্রকল্পের ৯টিতেই বাস্তবায়নে বিলম্ব, ব্যয় বৃদ্ধি ও সুবিধার ঘাটতি হয়ে থাকে। এ থেকে তিনি মেগা প্রকল্পের লৌহ কঠিন আইন (আয়রন ল অব মেগা প্রজেক্টস) খুঁজে পেয়েছেন। যা হলো, মেগা প্রকল্প মানেই ‘দফায় দফায় ব্যয় বৃদ্ধি, বাস্তবায়নে বিলম্ব, অনুমিত অপেক্ষা কম সুবিধা’ বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা দরকার।
প্রকল্প মেগা বা মিনি যা-ই হোক না কেন, তা নির্বাচনের নীতি কিন্তু অভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় অপেক্ষা এ থেকে প্রাপ্ত সুবিধা বেশি হতে হবে। কেননা, প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যই হলো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি করা। প্রকল্পের সুবিধা ব্যয় অপেক্ষা বেশি হলে ব্যক্তি বা সামাজিক সম্পদ বাড়ে আর সুবিধা অপেক্ষা ব্যয় বেশি হলে সম্পদ কমে।
ব্যক্তি খাতে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ক্ষেত্রে, নগদ প্রবাহ (ক্যাশ ইনফ্লো) থেকে নগদ বহিঃপ্রবাহ (ক্যাশ আউট ফ্লো) বাদ দিতে হয়। সরকারি বা সামাজিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে নগদ প্রবাহ (ক্যাশ ফ্লো) ছাড়াও অন্যান্য সামাজিক ব্যয় এবং সামাজিক সুবিধা হিসাব করা হয়। উদাহরণস্বরূপ একটি সেতু প্রকল্পের আর্থিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কেবল সেতু নির্মাণের ব্যয় ও এর টোল রাজস্ব বিবেচনা করা হবে। একই প্রকল্পের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত ব্যয় ছাড়াও প্রকল্পের কারণে পরিবেশের ক্ষতি, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের পুনর্বাসনের ব্যয় ও প্রকল্প এলাকার লোকের বাড়তি সুবিধা বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা দেখেছি যে যমুনা সেতু প্রকল্পের ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে সবজি ও ফসলের আবাদ বাড়বে, যা বিবেচনায় নিয়ে আমরা বিশ্বব্যাংককে এ প্রকল্পের বাড়তি অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদর্শন করে তাদের প্রকল্প অর্থায়নে রাজি করাই। প্রকল্প বাস্তবায়নে একাধিক বছর অর্থব্যয় করতে হয় এবং বহু বছর ধরে প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়া যায়। তাই ব্যক্তি খাত কিংবা সামাজিক খাত, উভয় ক্ষেত্রেই প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় ও সুবিধা দুটোই প্রকল্প শুরুর বছরে সমন্বয় করে নিতে হয়।
প্রকল্প বিচারের মানদণ্ডগুলো হলো (১) সুবিধা ও মূল্যের অনুপাত (বেনিফিট কস্ট রেশিও), (২) নিট বর্তমান মূল্য (এনপিভি), (৩) আর্থিক ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (আইআরআর) ও (৪) অর্থনৈতিক রেট অব রিটার্ন (ইআরআর)। তৃতীয় ও চতুর্থ মানদণ্ড একই প্রক্রিয়ায় হিসাব করা হয়ে থাকে। ‘আইআরআর’ বা ‘ইআরআর’ এমন একটা হার, যা দিয়ে সমন্বয় করলে প্রকল্পের ‘নিট বর্তমান মূল্য’ শূন্য হবে। মূল পার্থক্য হলো, চতুর্থ মানদণ্ডটি কেবল সরকারি বা সামাজিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যেখানে ব্যক্তিগত সুবিধা ও মূল্যের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সুবিধা ও মূল্য বিবেচনায় নেওয়া হয়ে থাকে। প্রকল্প গ্রহণে সিদ্ধান্তের নিয়মগুলো হলো (১) সুবিধা ও মূল্যের অনুপাত ১-এর বেশি হতে হবে; (২) নিট বর্তমান মূল্য ধনাত্মক হতে হবে এবং দুটি বিকল্প প্রকল্পের মধ্যে যেটির নিট বর্তমান মূল্য বেশি তা গ্রহণ করতে হবে; (৩) আর্থিক বা অর্থনৈতিক ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন প্রকল্প অনুমোদনের জন্য ‘নির্ধারিত হার’ থেকে বেশি হতে হবে।
আমাদের দেশে যেকোনো বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়/বিভাগকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়ন করে তা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়/একনেকের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হয়। প্রকল্পের কারিগরি ও জনবল ছাড়াও এর আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ‘ডিপিপি’র অন্তর্ভুক্ত থাকে। দেখা যায় যে প্রকল্পের অনুমোদনকালে মানদণ্ড অনুসরণ করা হলেও পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি বা বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটলে এসব হিসাব সংশোধন করা হয় না।
কিস্টোন রিসার্চ পদ্মা সেতু ও মাতারবাড়ী সমন্বিত বিদ্যুৎ, এ দুটি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও বিলম্বে বাস্তবায়ন, প্রকল্পগুলোর আর্থিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়নের ওপর কী প্রভাব ফেলেছে, তা বিশ্লেষণ করেছে। কিস্টোন রিসার্চের মূল্যায়ন সংক্ষেপে নিচে দেওয়া হলো:

পদ্মা সেতু
মূল ডিপিপিতে পদ্মা সেতুর প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ১৯ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। সর্বশেষ প্রাক্কলনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে সর্বশেষ ২০২০ সালে এটা চালু হবে ধারণা করা হচ্ছে। মূল ডিপিপিতে সুবিধা ও মূল্যের অনুপাত ২ দশমিক ২৬, নিট বর্তমান মূল্য ১৫ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা অর্থনৈতিক রেট অব রিটার্ন ২১ দশমিক ৮ শতাংশ হিসাব করা হয়েছিল। অর্থাৎ পদ্মা সেতু প্রকল্পটি তিনটি মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও বিলম্বিত বাস্তবায়নের ফলে সুবিধা ও মূল্যের অনুপাত শূন্য দশমিক ৮৭, নিট বর্তমান মূল্য ঋণাত্মক ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা, অর্থনৈতিক রেট অব রিটার্ন ১১ দশমিক ০৯ শতাংশে নেমে আসে। অর্থাৎ প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নে বিলম্ব বিবেচনায় নিলে পদ্মা সেতু প্রকল্প কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য থাকছে না।

মাতারবাড়ী সমন্বিত বিদ্যুৎ প্রকল্প
মূল ডিপিপিতে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৩২ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। সর্বশেষ প্রাক্কলনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার কোটি টাকায়। প্রকল্প বাস্তবায়নে দুই বছর বিলম্ব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মূল ডিপিপিতে সুবিধা ও মূল্যের অনুপাত ছিল ১ দশমিক ৪২, নিট বর্তমান মূল্য ১৩ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা, অর্থনৈতিক রেট অব রিটার্ন ১৮ দশমিক ০৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাতারবাড়ী প্রকল্পটিও তিনটি মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য ছিল। এ ক্ষেত্রেও প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও বিলম্বিত বাস্তবায়নের ফলে সুবিধা ও মূল্যের অনুপাত শূন্য দশমিক ৭৮, নিট বর্তমান মূল্য ঋণাত্মক ৮ হাজার ২২৫ কোটি টাকা, অর্থনৈতিক রেট অব রিটার্ন ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে আসে। অর্থাৎ প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নে বিলম্ব বিবেচনায় নিলে পদ্মা সেতুর মতো মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পটিও কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য থাকছে না।
এ ছাড়া দেখা যায় যে প্রকল্পগুলোর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কিছু অবাস্তব অনুমানের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যেমন মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ১৩ দশমিক ৫ টাকা। কিন্তু বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গড় ক্রয়মূল্য হচ্ছে ৬ দশমিক ৯১ টাকা। আবার পদ্মা সেতুর যানবাহন যাতায়াতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ যমুনা সেতুর প্রাথমিক পর্যায়ে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৫ শতাংশ। মনে রাখতে হবে, পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে জলপথে দক্ষিণাঞ্চলে অর্থাৎ বরিশাল, খুলনা যাতায়াতের বিকল্প রয়েছে, যেটা যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে ছিল না। তাই পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে যানবাহন যাতায়াতের প্রবৃদ্ধি সম্ভবত যমুনা সেতুর তুলনায় কিছুটা কম হবে। অর্থাৎ, অবাস্তব অনুমানের সাহায্যে প্রকল্পের সুবিধা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
উপরিউক্ত পর্যবেক্ষণগুলোর উদ্দেশ্য এটা নয় যে পদ্মা সেতু বা মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো মেগা প্রকল্পগুলোর প্রয়োজন নেই। তবে এ ধরনের মেগা প্রকল্প যথাসম্ভব নির্ধারিত ব্যয় ও সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায়, এ ধরনের মেগা প্রকল্পের ফলে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির পরিবর্তে হ্রাস পাবে। ব্রিটেনে চ্যানেল টানেল প্রকল্পের বাস্তবায়ন-পরবর্তী মূল্যায়নে প্রকল্পের প্রাক্কলিত সুবিধা ও ব্যয়ের সঙ্গে প্রকৃত সুবিধা ও ব্যয়ের তুলনা করে পরিসংহারে বলা হয়েছে যে ‘চ্যানেল টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হলেই তা ব্রিটিশ অর্থনীতির জন্য মঙ্গলদায়ক হতো।’ আমাদের মেগা প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও তা যেন না হয়। মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন প্রকল্প কোনো তাজমহল নয়। তাই মেগা প্রকল্প যেকোনো মূল্যে ও পর্যাপ্ত সুবিধা ছাড়াই বাস্তবায়ন করতে হবে—এমন ধারণা সঠিক নয়।
এম ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও মেগা প্রকল্প বিশ্লেষক।
[email protected]