যুবরাজ বড্ড তাড়াহুড়া করছেন

যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: এএফপি
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: এএফপি

সৌদি আরবে আজ যে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটছে, সেটা বোঝার জন্য আপনাকে দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বাস্তবতা দিয়ে শুরু করতে হবে। ব্যাপারটা হলো চার দশক ধরে যে বিষয়গুলো দেশটির রাজনীতিকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছে তা কিন্তু ইসলামি রাজনীতি, মৌলবাদ, উদারনীতিবাদ, পুঁজিবাদ ও আইএসবাদ নয়, সেটা হলো আলঝেইমার বা ভুলে যাওয়ার রোগ।
দেশটির বর্তমান বাদশাহর বয়স ৮১ বছর। তাঁর আগের বাদশাহ ৯০ বছর বয়সে মারা গেলে তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন, তাঁর আগের রাজা আবার ৮৪ বছর বয়সে মারা যান। তাঁরা কেউই যে সংস্কারের চেষ্টা করেননি তা কিন্তু নয়। ব্যাপারটা হয়েছে কী, পৃথিবীতে যখন প্রযুক্তি, শিক্ষা ও বিশ্বায়নের বদৌলতে অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে তখন এই সৌদি বাদশাহরা ভেবেছিলেন, দেশটির সংস্কারের গতি ঘণ্টায় ১০ মাইল হলেই যথেষ্ট। তবে তেলের উচ্চমূল্য সেটা পুষিয়ে দেয়।
কিন্তু এটা এখন আর কাজে আসছে না। সৌদি আরবের ৭০ শতাংশ মানুষের বয়স ৩০ বছরের নিচে, যাঁদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ বেকার। এ ছাড়া আরও প্রায় ২ লাখ মানুষ দেশের বাইরে পড়াশোনা করছেন। এঁদের মধ্যে আবার ৩৫ হাজার প্রতিবছর দেশে ফিরে অর্থপূর্ণ কাজ খুঁজছেন। কিন্তু তাঁদের যেন মসজিদ ও শপিং মলে যাওয়া ছাড়া কাজ নেই। উপার্জন কমে যাওয়া এবং সরকারের পক্ষে সঞ্চয় ব্যয় করে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব নয় বলে তাঁদের এখন তেল খাতের বাইরে অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাদশাহ সালমানের ৩২ বছর বয়সী সন্তান ও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) এমন বেপরোয়া ক্ষমতার খেলা শুরু করেছেন। আমি এই যবুরাজ এমবিএসের দুবার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এই তরুণ খুব তাড়াহুড়া করছেন। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই তরুণের সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা একদম খাঁটি, তাঁর প্রতি তরুণদের সমর্থন উল্লেখযোগ্য এবং দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার তাঁর এই প্রচেষ্টা অন্যদের বাধ্য করার ক্ষমতা রাখে।
বস্তুত তাঁর ব্যাপারে দুটি কথা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। তিনি যতটা ওয়াহাবি, তার চেয়ে বেশি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ; ধর্মগ্রন্থ নিয়ে তিনি যতটা বড়াই করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ তিনি করেন। তিনি যদি না থাকতেন, তাহলে সৌদি ব্যবস্থাকে তাঁর মতো মানুষ খুঁজতে হতো। তখন অন্য কাউকে এই ওলট-পালট করতে হতো।
কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই, সেটা হলো তাঁর দ্রুত সংস্কারের তাড়না কোথায় গিয়ে শেষ হয় আর ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের আকাঙ্ক্ষাই বা কোথায় শুরু হয়। ‘দুর্নীতির’ অভিযোগে গণমাধ্যমের মালিক ও ধনকুবেরদের গ্রেপ্তারের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশংসা করে টুইট করেছেন, ‘যাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকেই দেশটির “ক্ষতি” করার চেষ্টা করেছে’!
ওই টুইট পড়ে আমি শুধু হাসতে পারি, আর কিছু নয়। ব্যাপারটা হলো সৌদি যুবরাজদের ‘দুর্নীতির’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—এ কথা শুনলে মনে হয় ডোনাল্ড ট্রাম্প সাতজন মন্ত্রীকে ‘মিথ্যা বলার’ অভিযোগে বরখাস্ত করেছেন। সবাই জানেন, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই অন্য কিছু। দৃশ্যত ট্রাম্প এ খবর জানেন না যে যুবরাজ এমবিএস গত বছর দক্ষিণ ফ্রান্স সফরের সময় পছন্দ হওয়ায় ঝোঁকের বশে এক রুশ নাগরিকের কাছ থেকে ৫৫ কোটি ডলারে প্রমোদতরি কিনেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে তাঁর এই টাকার উৎস কী?
বিষয়টি তুলছি তার কারণ হলো আপনি যখন একসঙ্গে এত বড় পরিবর্তন করছেন এবং বহু শত্রু বানাচ্ছেন, তখন আপনার ভাবমূর্তি কিন্তু একদম পরিষ্কার হওয়া চাই। মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে যে আপনি যা বলছেন সেটা আপনি মনে করেন বা আপনার গোপন কার্যক্রম নেই। কারণ, পরিবর্তনটা খুব বেদনাদায়ক। এখন দেখা যাক এমবিএস একসঙ্গে কত কিছু করছেন: সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া দ্রুততর করার জন্য তিনি সৌদি রাষ্ট্র ঢেলে সাজাচ্ছেন। আগে যেমন সাতটি বড় পরিবারের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি হতো এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হতো, তার জায়গায় তিনি রাষ্ট্রকে এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চাইছেন। ফলে দেশটি এখন আর ‘সৌদি আরব’ নয়, এটি এখন ‘সালমান আরব’। এমবিএস এক ধাক্কায় সৌদি রাজপরিবারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যুবরাজ এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মূলোৎপাটন করেছেন। এ ছাড়া তিনি তিনটি আধা স্বাধীন বেসরকারি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এমবিসি, এআরটি ও রোটানার মালিকদের গ্রেপ্তার করেছেন।
এমবিএস মধ্যপন্থী সুন্নি ইসলামের জন্ম দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন, যা শুরু হবে ধর্মীয় পুলিশের কার্যক্রমে রাশ টেনে এবং নারীদের গাড়ি চালনার অনুমতি দিয়ে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে তিনি সাহস দিচ্ছেন, যাতে তাঁরা ধর্মানুভূতির ভিত্তিতে নয়, কাজের মাধ্যমে তাঁকে বিচার করেন। তিনি কেপিআই (কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) বোঝেন, অর্থাৎ কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, গৃহায়ণ ও স্বাস্থ্যসেবার সূচকের ভিত্তিতে তিনি কৃতিত্ব পরিমাপ করতে চান। তবে তিনি জাতীয় সংহতির ভিত্তি হিসেবে ওয়াহাববাদের জায়গায় অধিকতর ইহজাগতিক সৌদি জাতীয়তাবাদ সামনে আনতে চান, যার মধ্যে শিয়া/ইরান/পারস্যবিরোধী ধাঁচ আছে। এটাই বিপদের কারণ। তাঁর কারণেই তো লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি সৌদি আরবে বসে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। লেবাননে শিয়া, সুন্নি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে একধরনের ভারসাম্য ছিল। কিন্তু এই ঘোষণার পর দেশটি অস্থিতিশীল হয়ে গেল।
এক প্রবীণ সৌদি সাংবাদিক আমাকে বলেছেন, ‘এই মানুষটি সৌদি আরবকে ধীরলয়ের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তাঁকে আরও ছড়িয়ে পড়তে হবে। তিনি সৌদের ঘরকে ধর্মবেত্তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করছেন ভালো কথা, কিন্তু তিনি নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বেলায় ভিন্নমত সহ্য করছেন না।’
আমার উদ্বেগের কারণ হচ্ছে যাঁরা ইরানকে মোকাবিলায় এমবিএসকে আরও আগ্রাসী হতে তাড়া দিচ্ছেন, তাঁরা হয়তো তাঁকে ঘরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই যুদ্ধে ঠেলে দেবেন—সংযুক্ত আরব আমিরাত, ট্রাম্প ও তাঁর জামাতা জ্যারেড কুশনার এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই বললাম, আমি উদ্বিগ্ন।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
টমাস এল ফ্রিডম্যান: মার্কিন সাংবাদিক।