সাপমারার সাপেরা আজও করে দংশন

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পর গির্জার সামনে সমবেত নারীরা। প্রথম আলো ফাইল ছবি
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পর গির্জার সামনে সমবেত নারীরা। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঘটনাবহুল নভেম্বরে খুব কম বাঙালির মনে আছে ঠিক এক বছর আগে, গত বছরের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউনিয়নের কতিপয় গ্রামে পাকিস্তানি কায়দায় আগুন দেওয়ার ঘটনা। পাকিস্তানি না বলে মিয়ানমারের সাময়িক কায়দাও বলা যায়। শুধু আগুন নয়, গুলি করে খুনও করা হয় ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরোনো জনগোষ্ঠী নিরীহ সাঁওতালদের। চোরের মায়ের বড় গলার সুবাদে আর ‘ছোট জাতের’ মানুষদের বোবা হয়ে থাকার সুযোগে সেদিন কতিপয় সংবাদমাধ্যমে ‘বেশ করেছি ঠিক করেছি’ ধরনের সংবাদ পরিবেশন দুঃখ দিলেও অবাক করেনি। পরবর্তী সময়ে একটা বিদেশি গণমাধ্যমের বরাতে সরকারি উর্দিপরা রাষ্ট্রীয় অস্ত্রের বাহক ব্যক্তিদের প্রকাশ্য দিবালোকে আগুন দেওয়ার ঘটনা সারা দুনিয়া দেখে ফেলে, রাষ্ট্রীয় অস্ত্রবাহকদের শনাক্তও করে ফেলে তদন্তে নামা লোকজন। তারপরও প্রেসনোটের ঘাড় থেকে মোনায়েম খানরা নামে না। অবশেষে লোক-দেখানো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায়। কিন্তু তারপর কী হলো? তার আর পর নেই। নেই কোনো বিচার। এসব দেখে কষ্ট পেয়ে সুকান্তের কবিতার ভাষায় আমাদের এক বন্ধু বোধ হয় লিখেছিলেন:

‘সাবাস বাংলাদেশ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে
(ওদের) জ্বালাও পোড়াও কর ছারখার
ক্ষুদ্র ওরা গণ্য যে নয়।’

এটা কবির কষ্টের কথা, অভিমানের প্রতিধ্বনি। সাঁওতালরা সংখ্যায় কম হলেও তারা যে নগণ্য নয়, তার অনেক প্রমাণ আছে। তাদের বাপ-দাদার জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে এখন আমরাই তাদের বেআইনি দখলদার বলছি। শ্যামল হেমব্রমদের তাঁদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া দূরে থাক, তাঁর লাশটাও পরিবারের কাছে, তাঁর সমাজের কাছে ফিরিয়ে দিতে কত টালবাহানা, নিয়ম-কানুন এই স্বাধীন দেশে আমাদের দেখতে হলো! ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ আরেকটা কাজ করে, যেটা মিয়ানমারের সরকারি দস্যুরা এখনো করার সাহস দেখায়নি। পোড়া ভিটেগুলো ট্রাক্টর দিয়ে এমন করে চেষে দেয়, যা দেখে বোঝার উপায় ছিল না, দুদিন আগেও সেখানে মানুষের বসতি ছিল, শিশুরা খেলত, মায়েরা মাটির চুলায় ফুটাত ভাত-ফেন। দরবার, মুচলেকা, আবেদনপত্র দিয়ে ঘটনাস্থলে আমাদের সেবার যেতে প্রায় সাত দিন কেটে যায়। আমাদের চোখে ধরা পড়ে কাঁটাতার আর চষা জমি, চষা জমি আর কাঁটাতার।

চিনিকল কর্তৃপক্ষ আর সরকারি বাহিনীর নৃশংসতাকে রূপ দেওয়া হয় ‘বাঙালি বনাম সাঁওতাল বিরোধ’ হিসেবে। উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালপল্লির মানুষ পাশের গ্রামে অন্য সাঁওতালদের উঠোনে, দাওয়ায়, বারান্দায় আশ্রয় নেয়। কাঁটাতার আর সরকারি অস্ত্রবাহকদের মারমুখী অবস্থান নেওয়ায় শিশুদের স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে যায়। দুই স্কুল মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন শ ছেলেমেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে প্রায় ১০০ জন ছিল প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর পরীক্ষার্থী।

এই শিশুদের একটা ব্যবস্থা করতে আমরা যাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে। সেখানকার চারুকলার শিক্ষার্থীরা এককথায় রাজি হলো—সাঁওতাল আর অসাঁওতাল শিক্ষার্থীদের ভেতর প্রশাসনের তৈরি অবিশ্বাসের বিষ ঢুকতে না দেওয়ার জন্য সবাই মিলেমিশে কিছু করা হবে। ঠিক হলো, তারা একসঙ্গে এক ক্যানভাসে ছবি আঁকবে, যা খুশি আঁকবে, গান গাইবে গলা খুলে, ‘এদের’ গান, ‘ওদের’ গান মিলেমিশে আমাদের গান হবে। শিক্ষকদের নিয়ে গ্রামে বাড়ি বাড়ি যেতে কোনো কষ্ট হয়নি। শিক্ষকেরাও চাইছিলেন, ছাত্রছাত্রীরা ফিরে আসুক, বছর শেষে পরীক্ষা দিক সুস্থমতো। ছাত্রছাত্রীরা খুশি হয় শিক্ষকদের তাদের আর তাদের পড়শিদের গ্রামে দেখে। শুরু হয় আমাদের বুর্জোয়া ধাঁচের শান্তি প্রতিষ্ঠার কুচকাওয়াজ। দুই সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করানো সব কৌশল জারি থাকার পরও শিশুরা একই মাঠে একসঙ্গে আবার খেলাধুলা শুরু করে। আসতে থাকে স্কুলে, বিজয় দিবস উদ্‌যাপনের যৌথ পরিকল্পনা হয়। কাগজ কেটে লাল-সবুজ রঙের বিজয়ফুল তৈরি করে তারা।

দুই সম্প্রদায়ের শিশুরা মিলেমিশে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের শান্তি স্থাপনের জাঁকজমক কুচকাওয়াজে অংশ নিচ্ছিল। রং-তুলির ব্যবহার, খালি গলায় গান, বাদ্যের তালে গান, কবিতা, ছড়া—সবকিছুতেই সাঁওতাল ছেলেমেয়েরা যে নগণ্য নয়, তার প্রমাণ রাখছিল। ঢাকার কবি-সাহিত্যিক আর তাঁদের বন্ধুরা মিলে কয়েক লাখ টাকা তুলে দেন। আমরা সেই টাকা দিয়ে স্কুলের ব্যাগ, বই আর নানা শিক্ষাসামগ্রী তুলে দিই শিশুদের হাতে। সাঁওতাল শিশুরা দেয় অসাঁওতাল শিশুদের হাতে। অসাঁওতালরাও উপহার বিনিময় করে সাঁওতাল মায়ের সন্তানদের সঙ্গে। সমাপনী পরীক্ষায় সবাই বসে। সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকার ধরন দেখে জাহাঙ্গীরনগরের নবীন আর জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা তাকিয়ে থাকে অবাক বিস্ময়ে। অনেকে স্বীকার করে, ছবি আঁকার এ ধরন সম্পর্কে তাদের আগে কোনো ধারণাই ছিল না। আমরা আন্দোলিত হই, দুলে উঠি। পাহারায় থাকা ব্যক্তিরা অবসরে থাকলে লুঙ্গি পরে পান চিবোতে চিবোতে দেখে যায় শিশুদের কাণ্ড।

স্কুল ঘিরে তাদের এত আনন্দ কিন্তু স্কুল পেরোলেই শেষ হয়ে যায়। গ্রামে তাদের বাড়িঘর থিক থিক করে মানুষের ভিড়ে। পুলিশ আসে আসামির খোঁজে। কারও মনে শান্তি নেই। যাদের ঘর পুড়েছে, তাদের মনও পুড়ে গেছে। পোড়া মনে শান্তি আসে কীভাবে। শিশুরা যেন বাড়ি ফেরে না, গ্রামে ফেরে না, ফেরে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের ঘেরাটোপে। আমাদের সব সম্প্রদায়ের ভেতর শা‌ন্তি স্থাপনের গানবাজনা, দৌড়ঝাঁপ শিশু শান্তি কিসকুর কাছে যাত্রা-নাটকের পালা বলে মনে হয়।

একদিন বলেই ফেলে ও, ঘরে ফিরতে ফিরতেই রাস্তায়ই এই আনন্দের রং সাদা হয়ে যায়। মনে হয় সবটাই মেকি। মা হাসে না, বাবা হাসে না, গ্রাম হাসে না, আমরা হাসি কী করে? ১১ বছরের শান্তিকে কোন দার্শনিকের নামে ডাকব? মূলে গন্ডগোল, সমূলে তুলতে হবে গোড়া, সেটাই সে বলে দেয়। তারপরও নিজেদের সফলতায় মাটিতে আমাদের পা পড়ে না। স্কুল চালু হলো, পরীক্ষা হলো—গান গাইল, ছবি আঁকল শিশুরা। আর কী চাও, হাতে হাতে তালি বাজাও। শিক্ষকেরাও আপ্লুত। ফেরার দিন প্রধান শিক্ষককে বিদায়-সালাম দিতে গিয়ে জন্মের হোঁচট খেলাম। শান্তি কিসকুকে সকাল থেকে দেখতে না পেয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলাম, ‘শান্তি কই?’ তিনি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফারুককে বললেন, ‘এই, দেখ তো সাঁওতালটা গেল কই? আসতে বল।’

শান্তিদের কোনো নাম নেই। ওরা সবাই সাঁওতাল-বাগদিপাড়ায় থাকা ছোট জাতের মানুষ। হায় কপাল!

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।