ভুয়া খবরের যুগে সাংবাদিকতা

ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সাংবাদিকতা-বহির্ভূত যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর প্রচারের বড় বিপদের দিকটা হলো এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য অতি দ্রুতগতিতে সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: রয়টার্স
ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সাংবাদিকতা-বহির্ভূত যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর প্রচারের বড় বিপদের দিকটা হলো এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য অতি দ্রুতগতিতে সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাজ্যের হার্পার্স কলিন্স প্রকাশনা সংস্থার কলিন্স ইংলিশ ডিকশনারি ‘ফেইক নিউজ’ শব্দবন্ধকে ২০১৭ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছে। অভিধানটির লেক্সিকোগ্রাফাররা বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমে ১২ মাস ধরে এই শব্দবন্ধের যে মাত্রার উপস্থিতি লক্ষ করেছেন, সেটাকে ‘সার্বক্ষণিক সর্বব্যাপী উপস্থিতি’ বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলছেন, ২০১৬ সালের পর থেকে এই শব্দবন্ধের ব্যবহার বেড়েছে ৩৬৫ শতাংশ। অভিধানটির পরবর্তী মুদ্রণ সংস্করণে ‘ফেইক নিউজ’ একটা আলাদা ভুক্তি হিসেবে যোগ করা হবে বলে তাঁরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

ফেইক নিউজ বা ভুয়া খবর নতুন শব্দ বা ধারণা নয়। ‘খবর’ ও ‘ভুয়া খবর’ অনেকটা ‘সত্য’ ও ‘মিথ্যা’র মতোই সমান্তরালভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু যুগ ধরে। তাহলে এতকাল পরে এসে কেন এই শব্দের ব্যবহার এমন অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেল? জরিপকারীরা বলছেন, ২০১৫ সালের পর থেকে এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করে। ২০১৬ সালে খুব বেশি বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফেইক নিউজ কথাটা ট্রাম্পের মুখে কিংবা তাঁর টুইটার বার্তায় খুব বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এর বহুল পুনরুৎপাদন চলছে গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে। ট্রাম্প একবার ফেইক নিউজ বললে বা লিখলে অনলাইন সংবাদমাধ্যমে এর পুনর্ব্যবহার হচ্ছে লাখ লাখবার। এভাবেই এই শব্দের ব্যবহার গত এক বছরে ৩৬৫ শতাংশ বেড়ে গেছে।

অবশ্য ট্রাম্প যে কথাটার সদ্ব্যবহার করছেন তা মোটেই নয়। যে খবর তাঁর পক্ষে যাচ্ছে না বা যে খবর তাঁর জন্য বিব্রতকর বা ক্ষতিকর বলে তিনি মনে করছেন, সেটাকেই তিনি ফেইক নিউজ বলছেন। কিন্তু তাঁর বর্ণিত সব ভুয়া খবর আসলে ভুয়া নয়। তিনি এই শব্দটি লুফে নিয়েছেন নিজের প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে।

কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়ে ওঠার আগেই বিশ্বজুড়ে ফেইক নিউজ একটা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। এর প্রধান কারণ সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারমাধ্যমের ওপর পেশাদার সংবাদপ্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের অবসান। এটা ঘটতে শুরু করে ইন্টারনেট ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদানের সুবিধা সহজলভ্য হওয়ার পর থেকে। এর আগে সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও রেডিও—তথ্য প্রচারের এই তিন মাধ্যমের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের কল্যাণে যে অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম চালু হলো, তা সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর সেই একক নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দিল। এক্সট্রা-জার্নালিস্টিক প্ল্যাটফর্ম বা সাংবাদিকতা করে না এমন কতগুলো অনলাইন প্রতিষ্ঠান বা ক্ষেত্র তথ্য আদান-প্রদানের কাজ শুরু করল। যেমন ইয়াহু, গুগল, এমএসএন, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি। এগুলো সংবাদপ্রতিষ্ঠান নয় (পরে অবশ্য ইয়াহু নিউজ, এমএসএন নিউজ ইত্যাদি সংবাদ সার্ভিস চালু হয়েছে), কিন্তু তাদের হাতে তথ্য বা সংবাদ প্রচারের প্রযুক্তিগত সুবিধা অবারিত।

ভুয়া খবরের উৎপাদন ও প্রচারের এক বিরাট ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে ফেসবুক। গত বছর আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ভোটাররা ফেসবুকের ভুয়া খবরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন—এ রকম অভিযোগ উঠেছিল। নভেম্বর মাসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন যে ফেসবুকে ফেইক নিউজের ব্যাপারে তাঁর সতর্ক হওয়া উচিত। জাকারবার্গ স্বীকার করেছিলেন যে মার্কিন ভোটারদের ওপর ফেসবুকের ভুয়া খবরগুলোর প্রভাব খাটো করে দেখা তাঁর ঠিক হয়নি।

ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সাংবাদিকতা-বহির্ভূত যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর প্রচারের বড় বিপদের দিকটা হলো এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য অতি দ্রুতগতিতে সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো, যাদের অধিকাংশই তথ্যের সত্য-মিথ্যা খতিয়ে দেখে না। তাদের দ্বারা যেকোনো চাঞ্চল্যকর ভুয়া খবর মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো সংবাদমাধ্যমে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যম এখন সংবাদের প্রাথমিক উৎস হিসেবে ফেসবুক-টুইটারও ব্যবহার করে। কাজটা দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে করলে ঝুঁকির আশঙ্কা কম থাকে, কিন্তু অধিকাংশ অনলাইন সংবাদমাধ্যম তা করে না। ফলে ভুয়া খবরের পুনঃপুন ব্যবহার ঘটতেই থাকে।

ইন্টারনেটের প্রসারের এক পর্যায়ে সাংবাদিকতায় আরেক ধরনের কাজ শুরু হয়েছে, ভুয়া খবর বেড়ে যাওয়ার পেছন যার অবদান বিরাট। কাজটাকে ইংরেজিতে বলা হয় চার্নালিজম (Churnalism)। সংক্ষেপে ব্যাপারটা হচ্ছে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত খবরাখবর থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো জোড়া দিয়ে একটা নতুন সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করে নিজের নিউজ পোর্টালে প্রকাশ করা।

এই চার্নালিজমের মাধ্যমে অনলাইন সংবাদমাধ্যমে শুধু ভুয়া খবরের পুনরুৎপাদনই হচ্ছে না, এটা সাংবাদিকতা পেশায় একধরনের ধস ডেকে এনেছে। ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত সাংবাদিকতার দেশগুলোতে সাংবাদিকদের ব্যাপক হারে চাকরি হারানোর একটা বড় কারণ এই চার্নালিজম। একজন সাব–এডিটর ডেস্কে বসে গুগল ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে তথ্য টুকিয়ে সেগুলো জোড়া দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় তিন-চারটা সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করতে পারলে মোটা অঙ্কের বেতন দিয়ে রিপোর্টার রাখার কী দরকার—এই ফর্মুলায় সংবাদমাধ্যমের মালিকেরা প্রশিক্ষিত, পেশাদার ও দামি (এক্সপেনসিভ) সাংবাদিকদের ছাঁটাই করছেন।

যাহোক, পেশাদার সাংবাদিকদের চাকরি হারানো এই লেখার বিষয় নয়। ভুয়া খবর নিয়ে যে আলাপ সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে চলছে, তাতে বলা হচ্ছে এটা সাংবাদিকতার জন্য একধরনের সংকট। যদিও ভুয়া খবর নতুন কিছু নয়, তবু এটাকে একটা বড় সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে এ কারণে যে ‘খবর বা সংবাদ প্রতিবেদনের ছদ্মাবরণে অসত্য, ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং প্রায়শ-চাঞ্চল্যকর তথ্য’ প্রচারের প্রবণতা মাত্রাগত বিবেচনায় এতটাই বেড়েছে যে এর কারণে সাংবাদিকতার মূল উদ্দীষ্ট ‘পাবলিক গুড’ বা জনগণের মঙ্গলসাধন ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এটা জনগণের দিকের ক্ষতি। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমের তথা সাংবাদিকতা পেশারও ক্ষতি হচ্ছে এ কারণে যে ভুয়া খবরে সয়লাব সংবাদমাধ্যম জনগণের আস্থা ও সম্মান হারাচ্ছে।

উভয় পক্ষের স্বার্থে এই সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন; ‘ভুয়া খবর’ তৈরি ও প্রচারের প্রবণতা থেকে সংবাদমাধ্যমকে উদ্ধার করার প্রয়াস নেওয়া উচিত। কিন্তু কেউ বলতে পারছেন না কাজটা ঠিক কীভাবে করা যাবে।

অন্যদিক থেকে এই পরিস্থিতিকে পেশাদার সাংবাদিকতার জন্য একটা সুযোগ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। মানে, ভুয়া খবরে সয়লাব সংবাদমাধ্যমে মানুষ যখন সঠিক খবরটা খুঁজবে, তখন যেসব সংবাদপ্রতিষ্ঠান তাদের সঠিক খবরটা দিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে পারবে, তাদের প্রতি মানুষের আস্থা সৃষ্টি হবে। যেসব সংবাদপ্রতিষ্ঠান দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এই কাজ নিয়মিতভাবে করে যাবে, তারা একটা সময় বিকল্পহীন হয়ে উঠবে।

আসলে সারা দুনিয়ায় অনলাইন সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা যে এখনো মুদ্রণ সংবাদমাধ্যমের পর্যায়ে উঠতে পারেনি, তার প্রধান কারণ এটাই। পাঠকের আস্থা ও বিশ্বাসের দিক থেকে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোই এখনো ওপরে আছে। তাদের অনলাইন সংস্করণগুলোও একই রকমের সম্মান পাচ্ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে আমেরিকার দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ও ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের কথা। বাংলাদেশেও এই মডেলই কাজ করছে। এখানে ফেসবুক বা নিউজ পোর্টালগুলোর মাধ্যমে কোনো বিভ্রান্তিকর খবর ছড়িয়ে পড়লে সেটার সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে মানুষ প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার-এর অনলাইন সংস্করণে চোখ রাখে।

জনগণের এই আস্থাই দর্শন, পেশা ও ব্যবসা হিসেবে সাংবাদিকতার মূল শক্তি। ভুয়া খবরের যুগে সত্য খবর প্রচার করার দায়িত্বশীলতাই পেশাদার সাংবাদিকতাকে রক্ষা করবে।

মশিউলআলম: সাহিত্যিকসাংবাদিক