শতবর্ষে রুশ বিপ্লব, ভিন্ন চোখে

রেড স্কয়ারে বলশেভিক সেনাদের কুচকাওয়াজ
রেড স্কয়ারে বলশেভিক সেনাদের কুচকাওয়াজ

রুশ বিপ্লবের কথা উঠলেই আমার চোখে ভাসে গোলাম আম্বিয়া লুহানীর ভীতসন্ত্রস্ত মুখ। রুশ বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হয়ে পাবনার যুবক লুহানী মস্কোয় গিয়েছিলেন, রুশ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে কাজও করেছিলেন। ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর স্তালিনের গোপন পুলিশের তথ্যের ভিত্তিতে বিদেশি চর হিসেবে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে।

ঠিক কত লোককে স্তালিনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হতে হয়েছিল, সেই হিসাব এখনো অসম্পূর্ণ। সোভিয়েত ঐতিহাসিক রয় মেদভেদেভ তাঁর লেট হিস্ট্রি জাজ গ্রন্থে এই সংখ্যা দুই কোটির বেশি বলে উল্লেখ করেছেন। সোভিয়েত পেরেস্ত্রোইকার অন্যতম কারিগর, মিখাইল গর্বাচভের সহকর্মী আলেকসান্দর ইয়াকবলেভের হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা কমপক্ষে সোয়া তিন কোটি। আর ইয়োসেফ দিয়াদকিনের হিসাবে স্তালিনের আমলে (১৯২৮—১৯৫৪) নির্যাতন, খাদ্যভাব, যুদ্ধ ও অস্বাভাবিক কর্মপরিবেশের কারণে ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ হয়েছে, এমন মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটি। নির্যাতনে নিহত মানুষের মধ্যে ছিলেন বিপ্লবের সেরা সন্তানেরা, লেনিনের নিকট সহকর্মীরা, দেশ-বিদেশ থেকে আসা বিপ্লবে বিশ্বাসী মানুষ। তাঁদেরই একজন লুহানী।

রুশ বিপ্লবের সেই কদর্য ও বেদনাময় ইতিহাসের জন্য স্তালিনকে অভিযুক্ত করা খুবই ফ্যাশনদুরস্ত ব্যাপার। স্তালিন ক্ষমতায় টিকে ছিলেন ৩০ বছরের বেশি সময়। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে নতুন সাধারণ সম্পাদক খ্রুশ্চভ একটানা তিন ঘণ্টা ভাষণে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য সব দোষ চাপিয়েছিলেন স্তালিনের ওপর। মনে রাখা ভালো, এই খ্রুশ্চভই ছিলেন ইউক্রেনে স্তালিনের ফাঁসুড়ে। ১৯৪৬-৪৭ সালে বাধ্যতামূলক খাদ্য সংগ্রহ অভিযানের ফলে ইউক্রেনে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটে, তাতে প্রায় ৩০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। সে সময় ইউক্রেনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন খ্রুশ্চভ।

অনেকে স্তালিন আমলের হত্যাযজ্ঞের জন্য তাঁর ডান হাত গেনরিখ ইয়াগোদাকেও দায়ী করে থাকেন। কিন্তু সেই লোক শুধু গোপন পুলিশপ্রধান ছিলেন না, কমিউনিস্ট পার্টির মস্ত কর্তাও ছিলেন। শুধু তিনি কেন, সবই দেখেছেন-শুনেছেন দলের আরও সব বড় বড় নেতা, জেনারেল, বুদ্ধিজীবী। এক স্তালিনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাঁরা পার পাবেন কী করে? তাহলে তো হিটলারের ওপর সব দোষ চাপিয়ে পার পেয়ে যেতে পারতেন গোয়েবলস, গেরিং ও আইখম্যান।

পৃথিবীর প্রায় সব বিপ্লবের মতো রুশ বিপ্লবেরও শুরু এক মহান গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে। বস্তুত, ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় প্রথম যে বিপ্লব ঘটে, যার ফলে রুশ জার দ্বিতীয় নিকোলাইয়ের পতন ঘটে, তা নাগরিক অংশগ্রহণের হিসাবে সম্ভবত ১৯১৭ সালের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভাবনার অর্থে, সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের ভাষায়, ফেব্রুয়ারির বিপ্লব ছিল গণতান্ত্রিক সম্ভাবনায় পূর্ণ। এর ফলে একটি বহুপক্ষীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব হতে পারত, কিন্তু পারেনি। তার কারণ ফেব্রুয়ারি-পরবর্তী বুর্জোয়া সরকারের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা। ব্যর্থতার দায়ভার শুধু সেই সময়ের অস্থায়ী সরকার নয়, বিপ্লবী নেতাদের ঘাড়েও কম বর্তায় না। জার সরকারের পতন এত দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে ঘটে যে এরা কেউই ঠিক করে উঠতে পারেনি, এখন কী করা দরকার। লেনিন তখন দেশের বাইরে, জুরিখে। সেখান থেকে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের জীবদ্দশায় বিপ্লবের সাফল্য দেখা সম্ভব হবে না।’

গর্বাচভের ভাষায়, ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর রাশিয়া ছিল বিশ্বের সবচেয়ে মুক্ত একটি দেশ। সেই মুক্ত রাশিয়ার গর্ভ থেকে উঠে আসে অক্টোবর বিপ্লব। অথচ অপার সম্ভাবনার সেই বিপ্লব যে শেষ পর্যন্ত একটি ‘স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রে’ (গর্বাচভের কথায়) পরিণত হয়, তার একটি প্রধান কারণ, সফল ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর বিভিন্ন বিপ্লবী দলের সম্মিলিতভাবে কাজ করার অক্ষমতা। অন্য কারণ, সম্ভবত তার চেয়েও বড় কারণ, সব ক্ষমতা শুধু দলের শীর্ষ নেতার হাতে তুলে দেওয়া এবং ভিন্নমত দমনে সন্ত্রাস ব্যবহারে অতি আগ্রহ। স্তালিনের হাতে, রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিনের হাতেই এই প্রক্রিয়ার শুরু। গর্বাচভ তাঁর অন মাই কান্ট্রি অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড গ্রন্থে এ ব্যাপারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।

আমরা জানি, বিপ্লবের অনেক আগে, ১৯০৩ সালে রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা মেনশেভিক ও বলশেভিক—এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মেনশেভিকদের প্রস্তাব ছিল, দলের সদস্যপদ উন্মুক্ত থাকুক। লেনিন বললেন, না, শুধু পেশাদার বিপ্লবীদের জন্যই দলের সদস্যপদ খোলা থাকবে। এ দুই উপদল যাতে ফের এক হয়, তার জন্য অনেকেই চেষ্টা করেছেন, তাঁদের একজন মাকসিম গোর্কি। লেনিন তাঁর সেই অনুরোধ এককথায় বাতিল করে দিয়েছিলেন। লেনিন ও তাঁর বলশেভিক বন্ধুরা ছিলেন পেশাদারি বিপ্লবী, রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না। এত দ্রুত ও এত সহজে ক্ষমতা তাঁদের হাতে আসবে, এটিও তাঁদের হিসাবের বাইরে ছিল। বিপ্লব-পরবর্তী বিশৃঙ্খলা ও প্রতিশোধের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো আগাম পরিকল্পনা তাঁদের ছিল না। বিপ্লবের অব্যবহিত পর তাঁদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল একদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা, অন্যদিকে দলীয় নেতৃত্বে সব ভিন্নপন্থীকে ছেঁটে ফেলা। ২৫ অক্টোবর বিপ্লব সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পরপরই লেনিন সব ক্ষমতা বলশেভিকদের হাতে ধরে রাখার কার্যকর উদ্যোগ নেন। ২ নভেম্বর বলশেভিক পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির এক সিদ্ধান্তে তিনি দলের গৃহীত মতের বিরুদ্ধে যাঁরা, এমন সবাইকে দল থেকে বহিষ্কার করার প্রস্তাব আইনসিদ্ধ করে নিলেন। পরের বছর ১৬ মার্চ গৃহীত হলো আরও একটি অগণতান্ত্রিক প্রস্তাব। দলের এক গোপন বৈঠকে লেনিনের প্রস্তাব অনুসারে ঠিক হলো, কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরে কোনো উপদল গঠন করা যাবে না। এই আইনের অর্থ ছিল, দলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে যে কেউ, তা যত কেউকেটা নেতাই হোন না কেন, দলবাজির অভিযোগে বহিষ্কৃত হতে পারেন। পরে এ দুই সিদ্ধান্ত ব্যবহার করে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন স্তালিন। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ত্রৎস্কিকে প্রথমে দল, পরে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয় এ দুই আইনের জোরেই।

পরে ত্রৎস্কি দুঃখ করে লিখেছিলেন, বলশেভিকেরা নিজেদের বাদে অন্য সব দলকে ধ্বংস করেছিল। প্রথমে তারা সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বের স্থলে দলের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত করল, তারপর সেখান থেকে প্রতিষ্ঠিত হলো নেতার একনায়কত্ব।

সোভিয়েত ঐতিহাসিকেরা একসময় দাবি করতেন, সোভিয়েত–ব্যবস্থা হলো বিশ্বের সবচেয়ে সেরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কথাটা হাস্যকর, সোভিয়েতরা নিজেরাই অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী অভিযোগে তাকে বাতিল করেছে। লেনিন নিজে কিন্তু বিপ্লবের আগে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অনুগত থাকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘গণতন্ত্র ছাড়া প্রলেতারিয়েতের পক্ষে বিপ্লবে বিজয় অর্জন অসম্ভব, গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো পথে সে নতুন সমাজ গড়তে সক্ষম হবে না।’ লেনিনের এই উদ্ধৃতি ব্যবহার করে গর্বাচভ দুঃখ করে লিখেছেন, বিপ্লবের একদম গোড়া থেকেই সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলা শুরু করেন লেনিন। তিনি ‘নিজের মুখ সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে নেন’। এই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন গোর্কি। সাবেক স্ত্রী ইকাতেরিনাকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘এ কথা এখন স্পষ্ট যে রাশিয়া এখন আগের চেয়েও (অর্থাৎ জারের আমলের চেয়েও) বেশি স্বৈরাচারী পথে এগিয়ে চলেছে।’

ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য শক্তি ব্যবহারের যুক্তি প্রথম দেখান স্তালিন নয়, লেনিন। অক্টোবর বিপ্লবের এক প্রধান খুঁটি ছিল ক্রনশ্তাদ নৌবহর। কিছু কিছু অর্থনৈতিক দাবি ও অধিকতর গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের দাবিতে ক্রনশ্তাদের নৌসেনারা বিদ্রোহ করলে বলশেভিক পার্টির নির্দেশে তাদের বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করা হয়। হত্যা করা হয় এমন নাবিকের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। সেটি বিপ্লবের মাত্র দুই বছর পরের কথা। ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হচ্ছে—বুখারিনের এমন এক সমালোচনার জবাবে লেনিন বলেছিলেন, ফায়ারিং স্কোয়াড ছাড়া কবে কোথায় বিপ্লব সফল হয়েছে? ১৯২২ সালে লেনিনের পরামর্শে নতুন যে ফৌজদারি আইন কার্যকর হয়, তাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংস ব্যবহার আইনসম্মত বলে ঘোষিত হয়। বলশেভিক নেতা ও শ্রমিক সংগঠক মিখাইল তমস্কি সে সময় কিছুটা পরিহাস ও কিছুটা রূঢ় সত্য মিশিয়ে বলেছিলেন, রাশিয়ায় অবশ্যই সব ধরনের দলের স্থান রয়েছে, তবে এই মুহূর্তে শুধু তাদের একটি ক্ষমতায়, বাকি সবাই জেলে।

ক্ষমতার স্বার্থে অস্ত্র ও নির্যাতনকে কত দূর ব্যবহার করা যায়, সে ব্যাপারে লেনিনের মতামতের আরেক প্রতিফলন ছিল গোপন পুলিশ চেকার গঠনে। রুশ বিপ্লবের আগে জারের গোপন পুলিশের কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করেছিলেন লেনিন ও ত্রৎস্কি। তাঁরা দুজনেই সেই পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। অথচ ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই তাঁরা চেকা গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন, পরবর্তী সময়ে এই চেকাই হবে কেজিবি, যাকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকবেন স্তালিন।

গোর্কি যে বিপ্লবী রাশিয়াকে জারের আমলের চেয়েও খারাপ বলেছিলেন, তার একটি কারণ, তিনি নিজের চোখে এই গোপন পুলিশের অত্যাচারের সাক্ষী। অসংখ্য লেখক-শিল্পীকে রক্ষা করতে তাঁকে বারবার ছুটতে হয়েছে লেনিনের কাছে। এক হিসাবে বলা হচ্ছে, ১৯১৭ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে চেকার হাতে প্রতিবছর কমপক্ষে ২৮ হাজার মানুষকে রাজনৈতিক কারণে হত্যা করা হয়। প্রতি-তুলনায়, জার আমলে ১৮৮৬ থেকে ১৯১৭, এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে ফাঁসি দেওয়া হয় এমন মানুষের সংখ্যা ১৪ হাজার। শুধু গোপন পুলিশ নয়, জারের আমলে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানোর ধারাও অব্যাহত রইল লেনিনের বিপ্লবী রাশিয়াতে। আমরা আজ যাকে গুলাগ বলি (অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ অন্তরীণাবস্থা), তা-ও লেলিনের সময় থেকেই। বস্তুতপক্ষে, গুলাগ শব্দটি লেনিনের সময় শ্রমশিবির পরিচালনার জন্য যে সংস্থার প্রতিষ্ঠা হয়, তারই আদ্যক্ষর (গ্লাভনোয়ে উপ্রাভলেনিয়ে লাগেরেই)।

অক্টোবর বিপ্লব মানব ইতিহাসের একটি বড় ঘটনা, এ কথায় কোনো সন্দেহ নেই। নাৎসি জার্মানির উত্থানও একটি বড় ঘটনা, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবও একটি বড় ঘটনা অথবা ইরানের ইসলামি বিপ্লব দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা। কিন্তু সেই বড় ঘটনার পেছনে রয়েছে গভীর বেদনার, গভীর অবমাননার ইতিহাস। রুশ বিপ্লবের প্রভাবে বিশ্বের আরও অনেক দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে—চীনে, কিউবায়, নিকারাগুয়ায়, ইথিওপিয়ায়, উত্তর কোরিয়ায়। গত ১০০ বছরে এই বিপ্লবের যূপকাষ্ঠে নিহত হয়েছে প্রায় ১০ কোটি মানুষ। রুশ বিপ্লবের শতবর্ষে আমরা যেন সেই সব নিহত মানুষের কথা না ভুলে যাই।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।