সরকার যেভাবে আইন করে নির্বাচন সেভাবেই!

গত ২৬ অক্টোবর আমাদের নির্বাচন কমিশন একটি সংলাপ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, সরকার যেভাবে আইন করে দেয়, নির্বাচন কমিশনকে সেভাবেই নির্বাচন করতে হয় (প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর ২০১৭)। সিইসির বক্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও উদ্বেগজনক।

আমরা জানি যে সরকার পরিচালিত হয় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের দ্বারা। রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্যই ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক ও সংগত। বস্তুত ক্ষমতায় গিয়ে সরকার গঠন করার লক্ষ্যেই রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। তবে যে সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুপস্থিত, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দুর্বল এবং নাগরিক সমাজ দুর্বল বা ক্ষমতাসীনদের অনুগত, সে সমাজে ক্ষমতাসীন সরকার নগ্ন কোটারি স্বার্থে আইনকানুন ও বিধিবিধানে পরিবর্তন এনে এবং প্রশাসনিক যন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সক্ষম হয়। এ কারণেই দলীয় সরকারের অধীনে আমাদের দেশে যত নির্বাচন হয়েছে, সব নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতায় টিকে ছিল। আর এ থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যেই আমাদের দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠেছিল এবং সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

আমাদের সংবিধানের ১১৯(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী (ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; (খ) সংসদ-সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; (গ) সংসদে নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন; এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতি পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুত করিবেন।’ আর নির্বাচন মানেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের ভাষায়, ‘আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বাইরে অন্য কিছু ভাবার কোনো অবকাশ নেই এবং যে আইন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কমিশনের হাত বেঁধে দেয়, তা সাংবিধানিকতার মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হবে’ (কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, পৃ. ৯৭৩)

সিইসির বক্তব্য উদ্বেগজনক। কারণ, আমরা মনে করি যে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব যেভাবে সরকার চায় সেভাবে নির্বাচন করা নয়, বরং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, যে নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত ও কার্যকর করবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানিকীকরণের একটি আবশ্যিক পূর্বশর্ত হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। অপরদিকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো: (১) ভোটার হওয়ার যোগ্য সব ব্যক্তির ভোটার হতে পারা; (২) নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী সবার প্রার্থী হতে পারা; (৩) নির্বাচনে ভোটারদের সামনে সত্যিকারের বিকল্প থাকা; (৪) ভোটারদের নির্বিঘ্নে ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে পারা; (৫) প্রদত্ত ভোটের সঠিকভাবে গণনা হওয়া; এবং (৬) পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিশ্বাসযোগ্য হওয়া। কারও তৈরি ছক অনুযায়ী নির্বাচন করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয় এবং এ জন্য এর সৃষ্টিও হয়নি। কমিশনের সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে।

আর নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য কমিশনকে অগাধ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আবুল কাশেম বনাম আলতাফ হোসেন মামলার রায়ে [৪৫ ডিএলআর (এডি) (১৯৯৩)] কমিশনের ‘তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণে’র বিধানের অধীনে প্রদত্ত ‘অন্তর্নিহিত ক্ষমতা’ কাজে লাগিয়ে ‘কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজনও করতে পারে।’ তাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন অসাধারণ ক্ষমতাধর একটি প্রতিষ্ঠান।

আমাদের আশঙ্কা যে নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতার ব্যাপকতাই নয়, তাদের দায়বদ্ধতার গুরুত্বও যেন অনুধাবন করতে পারছে না। রাজনৈতিক দলের দায়বদ্ধতা মূলত তাদের সদস্যদের কাছে হলেও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশনের দায়বদ্ধতা নাগরিকদের কাছে। আর এ দায়বদ্ধতা হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। তা করতে না পারলে কমিশন তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে, যার পরিণতি জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার বরখেলাপ। আর কমিশন যদি জনস্বার্থে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অপারগ হয়, তাহলে কমিশন সদস্যদের, যার মধ্যে সিইসিও অন্তর্ভুক্ত, এই গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদ আঁকড়ে ধরে থাকার কোনো যৌক্তিকতা থাকে না।

আমরা মনে করি যে সংলাপ শেষে ‘বল’ এখন নির্বাচন কমিশনের ‘কোর্টে’ এবং কমিশন সদস্যদের এ মুহূর্তে কর্তব্য হবে সংলাপ থেকে এবং অন্যভাবে প্রাপ্ত সব প্রস্তাব মূল্যায়ন করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য প্রস্তাবগুলো বেছে নেওয়া। বেছে নেওয়া প্রস্তাবের মধ্যে যেগুলো কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে কমিশনের অন্যতম প্রথম করণীয়। আর বেছে নেওয়া যে প্রস্তাবগুলো কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত, কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হবে কমিশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয়। প্রস্তাব বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই হবে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড, কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কি পড়ে না তা নয়। কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কি পড়ে না তা যদি প্রস্তাব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে পরবর্তী নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হয়ে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা অনুযায়ী হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে পড়বে।

সরকার অবশ্য কমিশনের অনুরোধ রাখতেও পারে, নাও রাখতে পারে, যদিও কিছু অনুরোধ রাখা সরকারের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। যেমন, কমিশন যদি নির্বাচনী ময়দানকে সমতল করার লক্ষ্যে নির্বাচনের পূর্বে সংসদ ভেঙে দেওয়ার অনুরোধ করে, সরকারের পক্ষে তা অতি সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। প্রসঙ্গত, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি খায়রুল হক নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। প্রসঙ্গত, বর্তমানে স্থানীয় সরকার পর্যায়েও নির্বাচনের আগে মেয়র ও চেয়ারম্যানদের পদত্যাগ করতে হয়।

সরকার যদি কমিশনের অনুরোধ উপেক্ষা করে, তাহলে কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা এমতাবস্থায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হবে কি না। যদি কমিশন মনে করে তা সম্ভব হবে না, তাহলে কমিশন সদস্যদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁরা নির্বাচন নিয়ে সামনে এগোবেন কি না। কমিশন সদস্যদের সামনে আরেকটি বিকল্প হবে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো, যেমনিভাবে ড. হুদা কমিশন ২০১২ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে পদত্যাগের উদ্যোগ নিয়েছিল। কারণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে না পারলে কমিশনের দায়িত্বে থাকার কোনো অধিকার নেই।

পরিশেষে, এটি আজ সুস্পষ্ট যে বিগত রকিবউদ্দীন কমিশন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি বিতর্কিত, পক্ষপাতদুষ্ট ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধতা পালনে তথা জনস্বার্থ সমুন্নত রাখতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর এ বিতর্কিত নির্বাচনের ফলে আজ জাতি হিসেবে আমরা অনেক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমাদের বর্তমান কমিশনও যদি আগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে আবারও ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা চরম বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হতে পারি, যার পরিণতি কারও জন্যই মঙ্গলকর হবে না। তাই আশা করি আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে সংশ্লিষ্ট সবারই শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং তাঁরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন।

. বদিউলআলমমজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনেরজন্যনাগরিক (সুজন)