নূর হোসেন, গণতন্ত্র মুক্তি পাক আর আমি

ছবি: পাভেল রহমান
ছবি: পাভেল রহমান

সন্ধ্যার পর দৈনিক ‘ইত্তেফাক’-এর ডার্ক রুমে মহা ব্যস্ত বিখ্যাত দুই ফটোগ্রাফার—রশিদ তালুকদার ও মোহাম্মদ আলম। আজ ১০ নভেম্বর, ১৯৮৭। সারা দিনের উত্তপ্ত ঢাকার ছবি ডেভেলপ করছিলাম আমি আর মোহাম্মদ আলম। এনলারজারে ছবি প্রিন্ট করছেন রশিদ তালুকদার। আমাদের তিনজনের প্রায় ১২টা, ৩৫ মিলিমিটারের ফিল্ম। ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা, প্রায় ১২ ঘণ্টায় ঢাকার রাজপথে আমরা ছিলাম সবাই ক্লান্ত। প্রেস ফটোগ্রাফির এই এক বড় চ্যালেঞ্জ। ছবি তোলার পর সারা দিন যত ক্লান্তি আসুক না কেন, ছবি প্রিন্ট করে ক্যাপশন লিখে সাবমিট করতে হবে, তারপর ছুটি।

রশিদ তালুকদার দেখে-বুঝে ছবি প্রিন্ট করছেন। আজ অনেক ঘটনা। কোনো ছবি যেন মিস না যায়, সেই দিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি। আমরা রশিদ ভাইকে সহযোগিতা করছি।

এমন সময় ডার্ক রুমের কড়া নড়ে উঠল।

কে কে? রশিদ ভাই জানতে চাইলেন।

বাইরে ‘নিউ নেশন’-এর জুনিয়র রিপোর্টার তারেকের আওয়াজ।

‘পাভেল ভাই, আপনি যে ছেলেটার কথা বলেছিলেন, শরীরে লিখে এসেছিল, সেই ছেলেটি মারা গেছে। ছবিটা অবশ্য প্রিন্ট করবেন তো।’

তারেকের কথায় রশিদ ভাই চমকে উঠলেন, আলম ভাইও!

‘কোন ছেলেটা মারা গেছে, পাভেল?’

আমি অন্ধকারে নিজেকে লুকাতে চেষ্টা করি। আমি ভাবছিলাম, ওটা আমার এক্সক্লুসিভ ছবি। তাই কাউকে বলতে চাইনি। যদিও আমরা একই গ্রুপের কাগজ—‘ইত্তেফাক’ আর ‘নিউ নেশন’। এরপরও আমার ইংরেজি দৈনিকে ছবিটি এক্সক্লুসিভ থাকুক—ভেবেছিলাম, কিন্তু তারেক এ কী করল?

এমনভাবে হাটে হাঁড়ি ভাঙল! রশিদ ভাইকে কী উত্তর দিই?

আমতা-আমতা করে বললাম, ‘ওই যে একটা ছেলে শরীরে লিখে এসেছিল, আমি তুলছিলাম। ও নাকি মারা গেছে—তাই তো বলল।’

দায়সারাভাবে বললাম ব্যাপারটা। রশিদ ভাই বললেন, ‘সে যা-ই হোক, নেগেটিভ কোথায়?’

বললাম, ‘ওখানেই আছে। আপনি ছবি প্রিন্ট করতে থাকেন, আমি দিচ্ছি।’

আমার মাথায় তখন ছবিটাকে বাঁচানোর চিন্তা। ‘ইত্তেফাক’ যেন না পায়। ওটা আমার ‘নিউ নেশন’-এর এক্সক্লুসিভ! ১০-১২ মিনিট কেমিক্যালে কাজ করার পর আমি বললাম, ‘আমি একটু ওয়াশরুমে যেতে পারি?’

রশিদ ভাই বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘এত কাজ আজ, তোমার আবার ওয়াশরুমে যাবার সময় হলো?’

আমি বললাম, ‘যাব আর আসব।’

রশিদ ভাই বললেন, ‘তাড়াতাড়ি আয়।’

আমি ছুটলাম তেতলার ‘নিউ নেশন’-এর নিউজ রুমের দিকে।

তারেককে সামনেই পেলাম। বললাম, ‘তারেক, আপনি তো আমার এক্সক্লুসিভের বারোটা বাজিয়েছেন। “গণতন্ত্র মুক্তি পাক” ছবিটা তো “ইত্তেফাক”-এ চলে যাচ্ছে! রশিদ ভাই আপনার কথায় জেনে গেছেন ওই ছবিটা আমি তুলেছি।’

তারেক লজ্জিত হলেন। বললেন, ‘কী করা যায়?’

আমি বললাম, ‘আপনি একটু অভিনয় করতে পারবেন? আপনি আবার আসেন ডার্ক রুমে এবং জোরে জোরে বলবেন, ‘ওই ছেলেটা মরেনি, খবরটা ভুল ছিল।’ আমি ফিরে যাওয়ার পরই তারেক ডার্ক রুমে এলেন। উঁচু গলায় আওড়ালেন আমার শেখানো বুলি। তাঁর কথা শুনে রশিদ ভাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, ‘উফ, আজ এত ছবি! বাঁচা গেল! থাক থাক, বাদ দে, ছেলেটা যখন মরে নাই। দরকার নাই।’

রশিদ ভাই যত না বাঁচলেন, তাঁর চেয়ে যে আমি বাঁচলাম!

একটু পরে একা ডার্ক রুমে এসে ছবিটা প্রিন্ট করে নিউজ রুমে নিয়ে এলাম। এ সময় বার্তা সম্পাদক আমানউল্লাহ কবীরের সামনে নিয়ে এলাম ছবিটি। পুরো অফিস স্টাফ ছবিটির সামনে ভিড় জমিয়ে তুলল।

স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছবিটি প্রকাশে বাধার সম্মুখীন হতে হলো বেশ কিছু সময়। কোনোভাবেই ছাপা যাবে না—এমনই যখন পরিস্থিতি, তখন রাত ১টার দিকে আকস্মিকভাবে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ছবিটি প্রকাশে সম্মতি দিলেন। তবে প্রথম পাতার ফোল্ডার নিচে মাত্র দুই কলামজুড়ে ছাপার অনুমতি মিলল। লিড করা যাবে না।

১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ছবিটি ঢাকায় ‘নিউ নেশন’ পত্রিকায় এক্সক্লুসিভ ছবি হিসেবে (এককভাবে) ছাপা হলো।

ছাপার পর একটি ছবি লক্ষ শব্দের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠল। বিদ্যুৎগতিতে সেই বার্তা সারা দেশে ছড়িয়ে গেল ও স্বৈরাচারের পতনের ঘণ্টা বেজে উঠল।

আর আমি নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে বেড়িয়ে ছিলাম ঘর থেকে ঘরে। কারণ স্বৈরাচার আর তাঁর গোয়েন্দা বাহিনী খুঁজছিল আমাকে। প্রচার করছিল ছবিটি ‘বানোয়াট’।

পাভেল রহমান: জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্র সাংবাদিক