তারপরও তেমন কিছু হবে না

‘প্যারাডাইস পেপারস’ ফাঁস হওয়ার পর আমরা যেমন অনেক কিছু জানতে পেরেছি, তেমনি এর প্রতিক্রিয়াও অনেক কিছু জানা গেছে। প্রথমত আমরা জানতে পারলাম, রাজনীতিবিদ ও তারকারা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য অফশোর প্রতিষ্ঠানে টাকা বিনিয়োগ করছেন। গত রোববার থেকে এর যে প্রতিবাদ আসতে শুরু করে, সেগুলো বেশ মৃদুই ছিল। এর ইঙ্গিতটা হলো কর ফাঁকির ঘটনা ফাঁস হলেও তাতে বৃহত্তর পরিসরে তেমন কিছুর পরিবর্তন হবে না।
জার্মানির বিচারমন্ত্রী হেইকো ম্যাস সবচেয়ে জোরালো প্রতিক্রিয়া জানিয়ে নজর কেড়েছেন। সোমবার তিনি দাবি করেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যকার করসংক্রান্ত ছিদ্রগুলো বন্ধ করা হোক। কিন্তু তিনি রীতি থেকে অনেকটা দূরবর্তী অবস্থানই নিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ‘অধিকতর স্বচ্ছতার’ কথা বললেও এই অভিযোগ তদন্তের ব্যাপারে উৎসাহিত করেননি। আবার তিনি বিদ্যমান আইনে বড় পরিবর্তন আনার কথাও বলেননি। সম্ভবত এটা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয় যে তাঁর শাসক রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নামও এই নথিপত্রে উঠে এসেছে।
অন্যদিকে আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোর প্রতিক্রিয়ায় তেমন একটা জোর নেই বললেই চলে। এই দেশগুলোর কর আইনে নানা ফাঁকফোকর আছে, যা দিয়ে তারা করপোরেশন ও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। তাদের এই রীতির কারণে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো প্রতিবছর শত শত কোটি ডলারের রাজস্ব হারায়।
সম্প্রতি বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষক গ্যাব্রিয়েল জাকম্যান, টমাস তোরসোলোভ, লুডউইগ ভিয়ার দেখিয়েছেন, করব্যবস্থায় ছিদ্র থাকলে ভুক্তভোগী ও সুবিধাভোগীদের মধ্যকার পার্থক্যটা কত বড় হয়, সেটা যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিপ্রেক্ষিতে, তেমনি বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতেও। এই ফাঁসের বিষয়ে জার্মানিই বিশেষভাবে উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। কারণ ব্যাপারটা হয়েছে কি কর ফাঁকি ও অন্যান্য দুর্বলতার কারণে দেশটি তার প্রাপ্য করপোরেট করের এক-তৃতীয়াংশ পাচ্ছে না, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে যার হার যথাক্রমে ২০ ও ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
ট্যাক্স হ্যাভেন হচ্ছে সেই রকম জায়গা, যেখানে অবশ্যম্ভাবীরূপে আইন লঙ্ঘন না করে টাকা পাঠানো যায়। এ ধরনের জায়গা শুধু ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জেই আছে তা নয়, ইংলিশ চ্যানেলের দ্বীপ জার্সি এবং আরও পশ্চিমে ডাবলিনেও এমন জায়গায় অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এসব জায়গায় আবহাওয়া কিছুটা শীতল হলেও এগুলো কর ফাঁকির বিচিত্র ও নিরাপদ জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউরোপে যত পরিমাণ কর ফাঁকি দেওয়া হয়, তার দুই-তৃতীয়াংশের গন্তব্য এই স্থানগুলো। ওপরে যে তিনজনের কথা বললাম, তাঁদের মধ্যে একজন জাকম্যান এই হিসাব দিয়েছেন।
জার্মানিসহ কর ফাঁকির কারণে অন্য যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা ইউনিয়নের প্রতিবেশীদের কর ফাঁকির সুযোগ বন্ধ করতে চাপ দিলেও তাতে আংশিক কাজ হয়েছে। শিগগিরই যে তারা আরও অগ্রগতি করবে এমন সম্ভাবনাও নেই, এমনকি এই ফাঁসের পরও।
গত বছর এই একই সংগঠন অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম ‘পানামা পেপারস’ ফাঁস করে দিয়েছিল। তখনো আমরা দেখেছি, কোম্পানি, শীর্ষ কর্মকর্তা, ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী ও রাজনীতিকেরা কর ফাঁকি থেকে কীভাবে লাভবান হন। এই ফাঁসের পর অনেকেই পদত্যাগ করেছেন, অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে; আবার অনেকেই লজ্জার মুখে পড়েছেন। তা সত্ত্বেও এমন কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার হয়নি, যার মাধ্যমে ইউরোপের উক্ত নিরাপদ জায়গাগুলোকে এই বিতর্কিত রীতি বন্ধে রাজি করানো যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধিবিধানে এই পরিবর্তন আনতে প্রায় সর্বসম্মত সমর্থন লাগবে। এ কারণে ইউরোপে একধরনের বিসদৃশ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, ইউনিয়নে যেমন কর ফাঁকির কারণে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগীরা আছে, তেমনি সবচেয়ে লাভবান হওয়া দেশগুলোও আছে।
প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারি থেকে বোঝা গেল কর ফাঁকির সংস্কৃতি কতটা ব্যাপক। এমনকি শীর্ষ রাজনীতিক ও কর ফাঁকি রোধে আইন প্রণয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও এই দোষ থেকে মুক্ত নন। গত রোববার বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিবেদন করে যে এই নথিপত্রে কর ফাঁকি দেওয়া মানুষের তালিকায় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তা, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর এক সহযোগী ও ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির এক বড় দাতাও আছেন। পরদিন অন্যান্য গণমাধ্যমে খবর এল যে অ্যাপল ও নাইকির মতো বড় করপোরেশনগুলোও কর ফাঁকি দিয়ে অফশোর কোম্পানিতে টাকা রাখছে। তবে মার্কিন কোম্পানিগুলো আগেও ইউরোপে কাজ করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল বলে এই অভিযোগ বড় কোনো ঘটনা নয়।
ব্রিটেনের রানির এস্টেটের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ক্রিস অ্যাডকক এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রানির বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের সমর্থনে বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের বিনিয়োগ পরামর্শকদের শক্ত সুপারিশের ভিত্তিতেই এস্টেট এসব বিখ্যাত বেসরকারি ইকুইটি তহবিলে বিনিয়োগ করেছে।’
এই প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা যায়, শোরগোল সত্ত্বেও পরামর্শকেরা কর ফাঁকির নিরাপদ জায়গা হিসেবে অফশোর কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করাটা গ্রহণযোগ্য মনে করেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
রিক নোয়াক: ওয়াশিংটন পোস্টের লন্ডন প্রতিবেদক।