তরুণেরা সংকীর্ণ রাজনীতিতে আগ্রহী নয়

ভূমিকম্পের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি নেপাল
ভূমিকম্পের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি নেপাল

২৬ নভেম্বর থেকে নেপালে সংসদ ও প্রাদেশিক নির্বাচন শুরু হবে। গ্রাম ও পৌরসভা পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনও কয়েক মাস আগে হয়ে গেছে। এতে গ্রামাঞ্চলের মানুষের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে, কারণ, ১৪ বছর ধরে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল না। কিন্তু দেশটিতে গত ১০ বছরে নয়জন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, যার কারণে তারা আন্তর্জাতিক মহলের তামাশার পাত্রে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া গত ছয় দশকে নেপালে সংবিধান প্রণীত হয়েছে ছয়টি। এই তীব্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেছে। ফলে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে অর্থাৎ পুলিশ থেকে শুরু করে কূটনৈতিক বিভাগে বিদেশে পদায়নের ক্ষেত্রে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক প্রভাব ও পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এমনকি আমলা, বিচারক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত থাকতে হয়।

এ ছাড়া নেপালে স্বাপ্নিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব আছে। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব থাকায় লাখ লাখ নেপালি তরুণ উপসাগরীয় দেশ ও মালয়েশিয়ায় চাকরি খুঁজতে গেছেন। তা সত্ত্বেও গত এক দশকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। নেপালের জিডিপির ২ শতাংশ জোগান দিচ্ছে রেমিট্যান্স। এর একটি সামাজিক প্রভাব আছে। কারণ, এতে গ্রামাঞ্চলে কার্যত তরুণদের খুঁজে পাওয়া যায় না। নেপাল ২০০৮ সালে ধর্মনিরপেক্ষ ও ফেডারেল রিপাবলিকে পরিণত হয়। তবে এসব নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কারণ, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে গণভোট হয়নি। নেপালের ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দু। এই অবস্থায় ভারতের উত্তরাখন্ড, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ডানপন্থীদের উত্থানের কারণে নেপালের কমিউনিস্টদের কাজটা কঠিন হয়ে গেছে। মানুষের মন জয় করতে তাদের এখন অতিরিক্ত শ্রম দিতে হবে।

২০১৫ সালের নেপালে যে মারাত্মক ভূমিকম্প হয়, তাতে মানুষের বাড়িঘর, স্কুল ভবন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ইউনেসকোর ঐতিহ্যবাহী স্থান ধ্বংস হয়ে যায়, যেগুলো পর্যটনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। লাখ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও পুনর্গঠনের কাজে গতি আসেনি। বোধগম্যভাবেই ভূমিকম্পের ভুক্তভোগীরা এ ব্যাপারে হতাশ। অথচ রাজনৈতিক নেতারা ভূমিকম্পের পর নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকার ভাঙাগড়া, সংবিধান প্রণয়ন—এসব নিয়েই বেশি ব্যস্ত থেকেছেন। নেপাল মূলত পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল, অথচ এ বছর পর্যটকদের সংখ্যা সাত লাখের সামান্য বেশি অতিক্রম করেছে। ভিসা ব্যবস্থা উদারীকরণ করার পরও এ অবস্থা চলছে, যেখানে অধিকাংশ দেশের মানুষকে নেপালে পৌঁছানোর পর ভিসা দেওয়া হচ্ছে। এখানে পর্যটনের আরও সম্ভাবনা আছে। কারণ, দেশটির উত্তরে আছে হিমালয়, যেখানে চমৎকার ট্রেকিং পথ ও তীর্থযাত্রার অসাধারণ কিছু স্থান আছে: বৌদ্ধদের জন্য লুম্বিনি, হিন্দুদের জন্য পশুপতিনাথ। এসব জায়গা অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করতে পারে, যদি রাজনৈতিক নেতারা এ ব্যাপারে আরেকটু আন্তরিক হন।

দেশটির বিমানবন্দর, সড়ক, প্রধান মহাসড়ক ও বড় বড় অবকাঠামোর সংস্কার জরুরি হয়ে গেছে। নেপালে রেলপথ নেই বললেই চলে। আর সীমান্তের ঠিক ওপারে ভারতে প্রধান প্রধান রেললাইন আড়াআড়িভাবে চলে গেছে বলে তিরাই অঞ্চল সেই ব্যবস্থায় ঢুকতে পারেনি।

ব্যাপারটা হলো, নেপাল, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে অবকাঠামোর অভাব ও উন্নয়নকাজের ধীরগতির কারণে মানুষ অবকাঠামো খাতে চীনা বিনিয়োগের সমর্থক হয়ে উঠেছে। আর চীনাদের দ্রুত কাজ করার পরিচিতি আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এমন একটা ধারণা আছে যে ভারত দক্ষতার সঙ্গে চীনা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছে ঠিকই, অথচ অন্যরা সেটা করলে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে, যদিও আমাদের বাজার খুবই ছোট। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে চীনা প্রভাবের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার আগে নয়াদিল্লিকে তার প্রতিবেশী নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তাকে দেখতে হবে কোথায় তার তুলনামূলক সুবিধা আর অতীতে কোথায় তারা বোকার মতো ভুল করেছে। নিশ্চিতভাবেই নরেন্দ্র মোদির মতো শক্তিশালী নেতার নেতৃত্বে ভারত নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবমূল্যায়ন করতে পারে না, বিশেষ করে তার নিজের নিরাপত্তার বিনিময়ে। সে কারণে কথা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা আছে। ভারত শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভালো দিকের নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে পারে না।

চীনারা তিব্বতের লাসা-শিগাতসে থেকে নেপালের রাসুয়া সীমান্ত পর্যন্ত রেললাইন বসাচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এই লাইনে ট্রেন চলবে। এটা হলে বাংলাদেশ তিব্বতে পণ্য নিয়ে যেতে পারবে, একইভাবে তারা তিব্বত থেকে পণ্য আনতেও পারবে। ফলে পর্যটন, জলবিদ্যুৎ, যোগাযোগ, বাণিজ্য ও ট্রানজিটে বাংলাদেশ-নেপালের সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপক সুযোগ আছে।ছাড়া বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে জলবিদ্যুৎ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার সুযোগ আছে। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে, এসবই হতে পারে যদি আমাদের নেতারা বোঝেন যে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণসমাজ সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে অতটা আগ্রহী নয়।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

ড. নিশ্চল এন পান্ডে: কাঠমান্ডুর সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক।