বিনোদন? সবই হরমোনের খেল!

বিনোদন মানে আনন্দ, মজা। তবে আনন্দবাদীরা বিনোদনকে বলেছেন যে কাজ মনে আনন্দ দেয়। যেমন: মিউজিক, মুভি, থিয়েটার। এতে খাদ্যবিজ্ঞানীরা খেপে বলছেন, মোটেই না, খাবার মানুষের সবচেয়ে বড় বিনোদন। সব উৎসব-পার্বণে খাবার থাকা মাস্ট। উদরপূর্তিই বড় বিনোদন। এতে মুখ বেঁকিয়ে ক্রীড়ানুরাগীরা বলেছে, তাহলে খেলাধুলা কি ভেরেন্ডা ভাজে? ম্যাকডোনাল্ডসে যত মানুষ যায়, তার চেয়ে কম মানুষ কি ফুটবল-রেসলিং দেখে? খেলাধুলাই সবচেয়ে বড় বিনোদন। আর জীবনঘনিষ্ঠ দার্শনিকেরা বলছেন, কিসের খেলাধুলা? জীবনটাই বিনোদন। জীবিতরাই বিনোদিত। এমনকি জীবন্মৃত যার অবস্থা, সেও বিনোদন দিতে পারে। অসুস্থ নাট্যকার হেনরিক ইবসেনকে এক সকালে নার্স এসে বলল, ‘আজ আপনাকে বেশ সুস্থ লাগছে।’ ইবসেন বললেন, ‘তোমাদের কথা উল্টোও হয়।’ বলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিনি।

জীবনের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিনোদন। নারী-পুরুষের বিনোদনেই জীবন এসেছে, জীবন বিনোদনেই ভেসেছে। আর জীববিজ্ঞানীরা হেসে বলেছেন, ‘এই তো লাইনে এসেছ। গান-বাজনা-গল্প-কবিতা কিছু না, আসলে এন্টারটেইনমেন্টের সবকিছু ঘটে কিছু হরমোনের কারণে। বাকি সব বোগাস।’

ভয়াবহ কথা। শরীরের চার ধরনের হরমোন নাকি আমাদের নাচায়, গাওয়ায়, খেলায়, লেখায়, পড়ায়, হাসায়। এনডোরফিন, সেরোটোনিন, ডোপামিন আর অক্সিটোকিন। বিনোদনের হরমোন। চিন্তা করুন, ডিসকোতে লাল-নীল আলোয় শরীর বেঁকিয়ে, পেঁচিয়ে, ঝাঁকিয়ে যে তরুণ-তরুণীরা উদ্দাম নাচছে, ওরা নাকি নাচছে হরমোনের জন্য, ড্রাম বিটের জন্য না। এটা কোনো কথা? বিজ্ঞানী বলছেন, এটাই কথা। ডিসকোতে যারা নাচছে, ওরা নাচছে এনডোরফিন বা অক্সিটোকিন হরমোনের কারণে। আর টিভিতে নৃত্যশিল্পী বা কমার্শিয়াল মুভিতে নায়িকা নেচেছে সেরোটোনিন বা ডোপামিন হরমোনের জন্য। ওদের উচিত দুধ, শিম বা প্রোটিনজাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়া। লে ঠ্যালা ।

এনডোরফিনের কথাই ধরি। এটা নাকি ব্যথানাশক বিনোদন হরমোন। আমাদের গাছের ছাল পরা পূর্বপুরুষদের ভয়-ব্যথা দূর করত। জন্তুর ধাওয়া খেয়ে বেঁচে এসে এনডোরফিনের জোরে পূর্বপুরুষ-পূর্বনারীরা নেচে-গেয়ে বিনোদনে নিজেদের ভাসিয়ে দিতেন। এখন সেই ধাওয়াও নেই, তাই শরীরে এই হরমোনের কাজও কমে গেছে। অনেকে প্রশ্ন করেছে, ধাওয়া নেই মানে? মুভি-নাটকে নায়ক অপরিচিত নায়িকার পিছু লাগে, ভিলেন তো পিছু লেগেই থাকে। আর সবশেষে নায়কের ধাওয়া খায় ভিলেন। বিজ্ঞানী হেসে বলেছেন, এগুলো প্রি-স্ক্রিপ্টেড। তাই নাটক-মুভি বা এখনকার সভ্য নিরাপদ সমাজে এনডোরফিনের বিনোদন দেওয়ার কিছুই নেই। কিন্তু যে জীবন যানজটের, মাস্তান-ছিনতাইকারীর ভয়ের, জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তার এবং সবার ওপরে নাগরিক ভোগান্তির, সেই জীবনে ধাওয়া-খাওয়ার কোনো অভাব নেই।

তবে আশার বাণী শুনিয়েছেন বিজ্ঞানী। মুভির এসব মজার কাজকারবারে দর্শকদের নাকি বিনোদন দেয় সেরোটোনিন হরমোন। হোয়াট? খেপে গিয়ে মুভিপাগলরা বলেছে, মুভির কাহিনি বা অভিনয়ে দর্শক বিনোদিত হয় না, হয় সেরোটোনিনের জন্য? বিজ্ঞানী হেসে বলেছেন, একজাক্টলি। সেরোটোনিন হরমোন মজার কিছু দেখা বা চিন্তা করায় বিনোদিত করে। এটা মুভির জন্যও সত্য।

দর্শক: তাহলে ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ মুভি হিট হয়েছে শাহরুখ খানের জন্য না, সেরোটোনিনের জন্য?
বিজ্ঞানী: অতিরিক্ত সেরোটোনিনের জন্য। শাহরুখের জন্য আগেই দর্শকদের বেশি সেরোটোনিন নিঃসৃত হয়েছে, ফলে মুভি হিট।
দর্শক: যদি শাহরুখ অভিনয় না করে অলিমুদ্দিন করত, ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’-এর কী হতো?
বিজ্ঞানী: কম হিট হতো বা ফ্লপ করত। দর্শকের সেরোটোনিন তখন ঝিম মেরে থাকত।
দর্শক: সাম্প্রতিক যে একাধিক বাংলা মুভি হিট করেছে, সেগুলো?
বিজ্ঞানী: দর্শকদের সেরোটোনিনের জন্য।
দর্শক: কিছু ছবি সরে গেছে। কেন?
বিজ্ঞানী: তারা টের পেয়েছে, দর্শকেরা সেরোটোনিন ছাড়বে না। তাই।
দর্শক: কিছু ছবি হিট হয়েও হয়নি।
বিজ্ঞানী: দর্শকেরা সেরোটোনিন ছেড়েও ছাড়েনি।
দর্শক: তার মানে মুভি-নাটক দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ায় নির্মাতা-শিল্পী-কলাকুশলীদের কোনো ভূমিকা নেই?
বিজ্ঞানী: আছে। তবে ওদের না, ওদের ডোপামিন হরমোনের।
দর্শক: মানে?
বিজ্ঞানী: ডোপামিন হরমোন নির্ধারণ করে নির্মাতা কতটুকু ক্রিয়েটিভ হবে, শিল্পী কতটুকু তা ফুটিয়ে তুলবে, এর ওপর নির্ভর করছে পুরো ক্রিয়েশনের সফলতা।
দর্শক: প্রতিভা বলে কিছু নেই?
বিজ্ঞানী: ডোপামিনই প্রতিভা। যে যত সূক্ষ্মভাবে যত ডোপামিন উৎপাদন করবে, সে তত ক্রিয়েটিভ, তত লক্ষ্য অর্জন করবে। তবে এখানে অক্সিটোকিন হরমোন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দর্শক: সেটা আবার কী?
বিজ্ঞানী: ভালোবাসার হরমোন।
দর্শক: সে হরমোন তো সব মুভি-নাটকেই আছে। যেমন: ‘রোমিও-জুলিয়েট’, ‘দেবদাস’ বা ‘টাইটানিক’?
বিজ্ঞানী: তা আছে। বেশির ভাগ উপন্যাস-নাটক-মুভি ভালোবাসার অক্সিটোকিন হরমোনেই ভেসেছে। তবে প্রোডাকশন সফল করতে হলে মুভির জন্য নির্মাতা ও শিল্পীদের পারস্পরিক অক্সিটোকিন হরমোন ঝরাতে হবে। তাহলে টিমওয়ার্ক গড়ে উঠবে। আর এই ভালোবাসার বন্ধনে ডোপামিন দেবে ধাক্কা। লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে সবাই। হিট হবে প্রোডাকশন!
দর্শক: আমাদের টিভি দর্শকেরা জি বাংলা বা স্টার জলসা সিরিয়াল বেশি দেখছে। কেন?
বিজ্ঞানী: ওই যে ওদের নির্মাতা-শিল্পীরা অক্সিটোকিন আর ডোপামিন ঝরাচ্ছে বেশি। আর তাতে আমাদের দর্শকদের ‘মজা দেখার’ সেরোটোনিন বেড়ে যাচ্ছে। ওরা ধেয়ে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের দিকে।
দর্শক: ওদের ফিরিয়ে আনতে হলে কী করতে হবে?
বিজ্ঞানী: আমাদের নির্মাতা-শিল্পীদেরও যথেষ্ট ডোপামিন আর অক্সিটোকিন ঝরাতে হবে। এগুলোর অভাব দেখা দিয়েছে আমাদের।
দর্শক: ঠিকমতো ডোপামিন ঝরাতে পারলে আমাদের দর্শকদের মজার সেরোটোনিন বেড়ে যাবে?
বিজ্ঞানী: সেরোটোনিন তো বেড়েই আছে। ওদের টিভি রিমোটটা শুধু টুশ করে আমাদের চ্যানেলের দিকে ঘুরে যাবে।
দর্শক: সালমান-শাহরুখ-আমির, কার ডোপামিন বেশি?
বিজ্ঞানী: এটা নির্ভর করে অনেক ফ্যাক্টরের ওপর। শাহরুখের ডোপামিন দীপিকা পাড়ুকোনকে পেলে যতটা ঝাঁকি দেবে, আমিরের ডোপামিন দীপিকায় ততটা ঝাঁকি নাও দিতে পারে।
দর্শক: কারিনা কাপুরকে পেলে?
বিজ্ঞানী: আমিরের ডোপামিন তখন বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। আবার কারিনায় হয়তো সালমান খান নেতিয়ে থাকবে, কিন্তু কাজলে ওর ডোপামিন হয়ে উঠবে বর্ষার যমুনার মতো। আসলে শিল্পী বা নির্মাতাদের ব্যাপার পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মতোই।
দর্শক: কেমন?
বিজ্ঞানী: কোন বাতাসে কার ডোপামিনে ঢেউ উঠবে, বলা টাফ!

শায়ের খান: রম্যলেখক ও পরিচালক।