জিন্নাহ-কন্যা দিনার মৃত্যু

কন্যা দিনার সঙ্গে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ
কন্যা দিনার সঙ্গে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ

কুড়ি শতকে ভারত উপমহাদেশে ইতিহাস সৃষ্টিতে যাঁরা মহানায়কের ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে অজস্র লেখা হয়েছে এবং অব্যাহতভাবে হচ্ছে, কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও মানুষের আগ্রহ কম নয়। পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে তাঁরা কেমন ছিলেন, তা নিয়ে আজও লেখালেখির শেষ নেই। মানুষ জানত সুভাষচন্দ্র বসু অবিবাহিত। তাঁর নিখোঁজের অনেক দিন পর জানা গেল তাঁর জার্মান স্ত্রী জীবিত এবং বসু দম্পতির রয়েছে একটি মেয়ে। বসু-কন্যা এখনো বেঁচে আছেন, থাকেন জার্মানিতে।

পাকিস্তানের স্রষ্টা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন নীরস প্রকৃতির ও কঠিন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তাঁর বন্ধুবান্ধব বিশেষ কেউ ছিলেন না। ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক এম জে আকবর তাঁর এক বইতে লিখেছেন, তিনটি বিষয়ে জিন্নাহর আগ্রহ ছিল—আইন পেশায়, থিয়েটার হলে গিয়ে নাটক দেখায় এবং রাজনীতিতে।

জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা যশোবন্ত সিনহা একটি তথ্যনির্ভর গ্রন্থ লিখেছেন, যা এখন বহুপঠিত। তবে জিন্নাহর পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে খুবই কম। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় গান্ধী ও জিন্নাহ উভয়েরই পারিবারিক বন্ধু কাঞ্জী দ্বারকদাসের বইগুলো থেকে। দ্বারকদাসের সঙ্গে জিন্নাহর পত্নী রতনবাঈয়ের—জিন্নাহ তাঁকে ডাকতেন রাত্তি বলে—বন্ধুতা ছিল। এতটাই ঘনিষ্ঠতা ছিল জিন্নাহ দম্পতির সঙ্গে যে তাঁদের নিয়ে তিনি বই লিখেছেন: রাত্তি জিন্নাহ—দ্য স্টোরি অব আ গ্রেট ফ্রেন্ডশিপ। দ্বারকদাসও কোনো ছোটখাটো মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ের খ্যাতিমান লেখক, সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক নেতা। গান্ধী ও জিন্নাহ উভয়ের বাড়িতেই ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। এই দুই নেতা ও ভারতের রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর লেখা প্রায় দুষ্প্রাপ্য বইগুলো আমার সংগ্রহে রয়েছে। এখন তিনি প্রায় বিস্মৃত।

জিন্নাহর আপনজন বলতে মানুষ জানত তাঁর ছোট বোন ফাতেমা জিন্নাহকে। তিনিই সব সময় ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন। ষাটের দশকে বাঙালি নেতারা ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রার্থী করেছিলেন। জিন্নাহর স্ত্রী এবং তাঁদের একমাত্র সন্তান একটি মেয়ে যে ছিলেন, তা মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। জিন্নাহর কন্যা দিনা ওয়াদিয়া ৯৮ বছর বয়সে ২ নভেম্বর নিউইয়র্কে মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ ভারত ও পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।

জিন্নাহ কঠিন হৃদয়ের মানুষ ছিলেন বলে মানুষ জানে। স্ত্রীর প্রতি তিনি যথেষ্ট মনোযোগ দেননি। অবহেলা করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। কিন্তু দ্বারকদাসের লেখায় পাওয়া যায় ভিন্ন বর্ণনা। অনেক দিন অসুখে ভুগেছেন রতনবাঈ। তাঁর মৃত্যুর দিনেও জিন্নাহ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাতে তাঁর পরিচিতজনেরা একটু অবাকই হন। পরদিন রাতে দ্বারকদাস জিন্নাহর বাসভবনে যান। বহু কাজের লোক থাকলেও বাড়িটি সেদিন সুনসান। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে জিন্নাহর শয়নকক্ষে যান। ঘরে ঢুকে তিনি অবাক। জিন্নাহ ওয়ার্ডরোব থেকে রাত্তির সব কাপড়চোপড় বের করে সেগুলো ঘরের ভেতরে সাজিয়েছেন নিজের হাতে, কাজের লোক দিয়ে নয়। স্ত্রীর পোশাকগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। দ্বারকদাস লক্ষ করেন কঠিনহৃদয় রাজনীতিকদের দুই চোখের কোণে দুই ফোঁটা অশ্রুবিন্দু।

জিন্নাহর এক জীবনীকার লিখেছেন তাঁর সন্তান দুটি: তাঁর কন্যা দিনা এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান। এবং কাকতালীয় হলেও সত্য, তাঁর দুই সন্তানেরই জন্মদিন একই। দিনা ভূমিষ্ঠ হন লন্ডনে ১৯১৯ সালের ১৪-১৫ আগস্ট রাতে। পাকিস্তানের জন্ম ২৮ বছর পরে ১৯৪৭ সালের একই দিনে, ১৪-১৫ আগস্ট। দিনার জন্ম হয় নির্ধারিত সময়ের চেয়ে সপ্তাহ দু-তিন আগে। ওই দিন জিন্নাহ রতনবাঈকে নিয়ে নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ প্রসববেদনা ওঠে। দ্রুত স্ত্রীকে নিয়ে যান হাসপাতালে। দিনা বাবার আদল পেয়েছিল।

একমাত্র সন্তানের সঙ্গে নিঃসঙ্গ জিন্নাহর সম্পর্ক মধুর তো নয়ই, স্বাভাবিকও ছিল না। একপর্যায়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। এবং বাবার প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের নাগরিকত্ব না নিয়ে তিনি ভারতেই থেকে যান ভারতীয় নাগরিক হিসেবে।

জিন্নাহ সুদর্শন ছিলেন না। কিন্তু তাঁর কন্যা ছিলেন মায়ের মতো রূপসী। আকর্ষণীয় ও হাসিখুশি প্রকৃতির। জিন্নাহ যখন উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত (সেটা স্বাধীন ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্র নয়), তখন তাঁর মেয়ে প্রেমে পড়েন বিখ্যাত শিল্পপতি পরিবারের যুবক নেভিল ওয়াদিয়ার। একদিন দিনা জিন্নাহকে বলেন, ড্যাড আমি বিয়ে করব। জিন্নাহ বলেন, তোমার তো বয়স এখন কুড়িই হয়নি। তা কাকে পছন্দ করেছ? দিনা বলেন, তুমি ওদের পরিবারকে চেন। ওয়াদিয়া শিল্প পরিবারের নেভিল।

জিন্নাহ সোজা হয়ে বসেন। বলেন, বলো কী? ওরা তো পার্শি, মুসলমান নয়।

ওই সময় জিন্নাহর সহকারী ছিলেন এসসি চাগলা। বাবা-মেয়ের ঝগড়া তিনি দূর থেকে শুনতে পান: জিন্নাহ ক্রুদ্ধভাবে দিনাকে বলছেন, ইন্ডিয়ায় লাখ লাখ মুসলমান যুবক রয়েছে, তাদের কাউকে তুমি দেখতে পেলে না? একজন অমুসলমানকে বিয়ে করতে চাইছ?

জিন্নাহর মুখের সামনে আর কেউ তর্ক করার সাহস না পেলেও মেয়ে তো বাবাকে ভয় পায় না। বাবা যেমন যুক্তিবাদী, মেয়েও কম নয়। দিনার জবাব: তুমি তো মুসলমান। তুমি পেটিট-টাটা পরিবারের রতনবাঈ পেটিটকে বিয়ে করেছিলে কেন? মা তো মুসলমান ছিলেন না।

মেয়ের যুক্তির কাছে পরাজিত হয়ে খ্যাতিমান আইনজ্ঞ কণ্ঠ নামিয়ে যুক্তি দেন, যেমনটি আদালতে দিতেন কোনো মামলায়। বলেন, তোমার মা তো বিয়ের আগে মুসলমান হয়েছিল।

জিন্নাহর স্ত্রী ছিলেন উপমহাদেশের দুটি বিখ্যাত শিল্পপতি পরিবারের সন্তান। রতনবাঈয়ের প্রপিতামহ দিনশাহ মানেকজি পেটিট ভারতবর্ষের আধুনিক শিল্পের জনক এবং উপমহাদেশের প্রথম সুতাকলের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর আরেক প্রপিতামহ রতনজি দাদাভাই টাটা ছিলেন টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান। তাঁর দাদির মা সুজানে ব্রেরিয়ার প্রাচ্যের প্রথম নারী, যিনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করতেন। বিয়ের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন রতনবাঈ এবং নাম গ্রহণ করেন মরিয়ম জিন্নাহ। ধর্ম নিয়ে জিন্নাহর কিছুমাত্র আগ্রহ ছিল না, কিন্তু তাঁর রাজনীতি ছিল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ ও অধিকার নিয়ে। প্রতিপক্ষ যাতে অপপ্রচার চালাতে না পারে সে জন্যই তিনি স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেন। রতনবাঈ মা-বাবার দেওয়া নামই ব্যবহার করতেন, মরিয়ম নয়।

নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ের পর বাবার সঙ্গে দিনার সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। বলতে গেলে জিন্নাহ মেয়েকে ত্যাজ্য করেন, তবে তা আইনি নোটিশ দিয়ে করেননি। বিয়ের পরেও বাবা-মেয়ের মধ্যে পত্রালাপ হয়েছে, সামনাসামনি কথা হয়নি। চিঠিতে জিন্নাহ মেয়েকে ‘মিসেস ওয়াদিয়া’ সম্বোধন করতেন।

দিনার বিয়ে ও দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। টিকেছিল মাত্র পাঁচ বছর। বিবাহবিচ্ছেদের পরও দিনা বাবার কাছে ফিরে যাননি। দুটি সন্তান, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তিনি আলাদা থাকতেন।

এর মধ্যে উপমহাদেশ ভাগ হয়ে জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র: ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে। দিনা তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে যাননি, ভারতীয় নাগরিকই থাকেন। ১০ বছরে বাবার সঙ্গে তাঁর দেখাশোনা হয়নি। ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বরে জিন্নাহর মৃত্যু হলে মৃত বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে করাচিতে যান। তবে জিন্নাহ সমাহিত হওয়ার পরই বোম্বে ফিরে আসেন।

একপর্যায়ে দিনা তাঁর সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানে আসার কোনো আগ্রহ তাঁর ছিল না। তিনি দ্বিতীয়বার পাকিস্তানে আসেন ২০০৪ সালে। সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফ তাঁকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানান পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ক্রিকেট সিরিজ দেখতে। মোশাররফের পীড়াপীড়িতে তিনি পুত্র নাসলি ওয়াদিয়া এবং নাতি জাহাঙ্গীর ও নেসকে নিয়ে পাকিস্তানে দ্বিতীয় ও শেষবার এসেছিলেন। সে সময় তিনি করাচিতে জিন্নাহর সমাধিসৌধে যান এবং ভিজিটর্স বইতে লেখেন: ‘আমার জন্য এ এক অতি বেদনার ও বিস্ময়কর মুহূর্ত। মে হিস ড্রিম ফর পাকিস্তান কাম ট্রু।’ মায়ের মৃত্যুর পর ফুফু ফাতেমা জিন্নাহ তাঁকে মাতৃস্নেহে লালন করেন। ফাতেমা জিন্নাহকে পাকিস্তানে সম্বোধন করা হয় ‘মাদার-এ-মিল্লাত’। তাঁর সমাধিতেও দিনা শ্রদ্ধা অর্পণ করেন।

পাকিস্তানে জিন্নাহর কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। তাঁর মূল্যবান স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সবই ভারতে। তাঁর একমাত্র সন্তান হিসেবে সেসব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী দিনারই হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি সেগুলো কখনো দাবি করেননি। ভারত সরকার সেগুলো অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে অধিগ্রহণ করে। বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি ক্লদ ব্যাটলের পরিকল্পিত মুম্বাইয়ের অভিজাত সাউথ কোর্ট এলাকায় জিন্নাহর প্রাসাদোপম বাড়ি ‘জিন্নাহ হাউস’ নির্মিত হয়েছিল বিপুল অর্থ ব্যয়ে। সাড়ে ৭ বিঘা জমির ওপর মালাবার হিলের সমুদ্রমুখী ভবন ১৯৪৮ সালে ভারত সরকার দখল নিয়ে ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনকে ইজারা দেয়। পাকিস্তান সরকার দীর্ঘদিন বাড়িটির দাবি জানিয়ে আবেদন করেছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িকে অনুরোধ করেন জিন্নাহর বাড়িটি পাকিস্তানের কাছে  হস্তান্তর করতে। তিনি চেয়েছিলেন ওটিতে পাকিস্তানের কনসুলেট হবে। ২০০৭ সালে দিনা বোম্বে হাইকোর্টে এক রিট করেন বাড়িটি তাঁকে বুঝিয়ে দিতে। সম্ভবত সে রিটের চূড়ান্ত ফয়সালা এখনো হয়নি।

দিনা রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। ছেলে, মেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়েই তাঁর দিন কেটেছে। উত্তরাধিকারের রাজনীতি নয়, নিজের যোগ্যতায় যদি তিনি রাজনীতি করতে চাইতেন তাহলে ভারতেই হোক বা পাকিস্তানেই হোক অতি উঁচু পদ পেতে পারতেন। কারণ তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ঔরসজাত কন্যা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।