আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও

বিএনপির রোববারের সমাবেশে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া
বিএনপির রোববারের সমাবেশে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া

আমরা বলব, সরকারবিরোধী সমাবেশে যে চেহারা-চরিত্র আমরা দেখলাম, তার একটি বার্তা আছে। আশা করব, ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সেটা পাঠ করতে পারবে এবং সে অনুযায়ী তারা যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

কোনো দেশে শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারলেই তা গণতন্ত্রের জন্য সুফল দেয় না। দরকার একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতিও। এটা ভালো লক্ষণ যে আওয়ামী লীগের জন্য যা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল, সেসব বিষয়ে বিএনপির নেত্রী সংযত ছিলেন। তিনি পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। আওয়ামী লীগেরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানোর মধ্যে একটা শিষ্টাচারের ছাপ আছে। তারা বলেছে, বিএনপিকে সক্রিয় দেখতে আওয়ামী লীগের অনীহা নয়, আগ্রহ আছে। এমনকি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের প্রশ্নে কয়েক দিন আগে প্রথম আলোয় যে রিপোর্ট বেরোল, তা থেকে একটা ভিন্ন আঁচ পেলাম। মনে হচ্ছে, সেনা মোতায়েনের প্রশ্নে একটি নীতিগত মতৈক্য দুই বড় দলের মধ্যে তৈরি হলেও হতে পারে। কারণ, ওবায়দুল কাদের সরাসরি সেনা মোতায়েনের বিষয়টি নাকচ করে দেননি। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগও সেনা মোতায়েন চায়, তবে আইনমতে। সংলাপেও তারা বিদ্যমান আইনের বরাত দিয়েছে।

এ সপ্তাহে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম প্রথম আলোকে বলেছেন, বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের কথা কমিশন ভাবছে না। আবার নিউইয়র্কে গিয়ে ইসি মাহবুব তালুকদার ঠিকানাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সেনা মোতায়েন করা হবে। এ নিয়ে আমি তঁার সঙ্গে কথা বললাম। তিনি জানালেন, সেনা মোতায়েন থাকবে। কিন্তু তারা কী উপায়ে দায়িত্ব পালন করবে, সে বিষয়ে ভিন্নমত আছে। এর আগে সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করেছে। ভোটকেন্দ্রে যায়নি।

আর ইভিএম এখন শুধু স্থানীয় সরকারের আইনে আছে, আরপিওতে নেই। নির্বাচন কমিশন তা আরপিওতে ঢোকাতে চাইছে। কিন্তু আগামী নির্বাচনে তারা এটা চাইবে না। খালেদা জিয়ার কথায় আরও একটি ভরসা পাওয়া গেল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জিয়াকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক বলে মনে হয় ভালোই করেছেন। কারণ, বর্তমান কমিশনের প্রতি খালেদা জিয়ার আস্থা ব্যক্ত করার মনোভাবটা লক্ষণীয় ছিল। তিনি বলেছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। এখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে বোঝাতে হবে। কিন্তু তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি মানবেন যে বাস্তবে এই ক্ষমতা ইসির নেই। বিষয়টি রাজনৈতিক, এ বিষয়ে যা করার তঁাকে রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে এবং তঁাকেই করতে হবে।

ওই একটি অবস্থানের দিকে তাকালে মনে হয়, আমরা সিকি শতাব্দী আগের মাগুরার উপনির্বাচনের আগের অবস্থায় ফিরে গেছি। ক্ষমতাসীনেরাই সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান প্রতিবন্ধক। এই সময়ে আমাদের কোনো রাজনৈতিক উন্নয়ন নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক চাইলে আমাদের একটি মধ্যম পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। কোনো জিনিসই আগের মতো পুনরাবৃত্তি হয় না। একটা পরিবর্তন লাগে। ঠিক ২০১৪ সালের মতো একটি নির্বাচন ২০১৮ সালেও কি সম্ভব? সম্ভব করাতে চাইলে তার মূল্য কত চড়া হবে? মির্জা ফখরুলের কথা শুনে উদ্বেগ বেড়েছে। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচন হবে না। শেখ হাসিনা না সরে দঁাড়ালে কোনো নির্বাচন হবে না। আশা করব, গণতান্ত্রিক রাজনীতি জয়ী হবে। এতে কোনো একটি শর্ত, একটি ফর্মুলা কাজ করে না। রাজনীতিকে গতিশীল রাখতে হয়। নদীর মতো রাজনীতিকেও বঁাচিয়ে রাখতে হয়।

আওয়ামী লীগ অবশ্য স্মরণই করতে চাইছে না যে তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে মন্ত্রিত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। এবারের সংলাপে সহায়ক সরকারের নানা প্রস্তাব এসেছে। আমরা মনে করি, সরকারের ছাড় দেওয়ার জায়গাটা কী হতে পারে, সেটা এখন থেকেই নানাভাবে স্পষ্ট করা যেতে পারে। এ জন্য দুই তরফে এখনই আনুষ্ঠানিক সংলাপের দরকার নেই।

শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে, বর্তমান সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন হবে, আওয়ামী লীগ কেন এর ওপর খুব বেশি জোর দিচ্ছে? আর এটা যুক্তির কথা নয়। কারণ, তারা বিএনপিকে নিয়ে কী ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার করতে চায়, সেটা তারা তো বর্তমান সংবিধানের আওতায় করতে পারবে। সেটা তারা শেখ হাসিনার অধীনে করতে পারবে। সুতরাং ভয়টা এই সরকারপদ্ধতি নিয়েই। তাই এখন থেকেই দেশি-বিদেশি সুহৃদদের উচিত হবে এই একটি বিষয়ে একটা সমঝোতা তৈরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। আওয়ামী লীগ পুরোনো প্রস্তাব এবারও যে দেবে, তা বলেনি। আবার এর সম্ভাবনাকে সরাসরি নাকচও করে দেয়নি। অন্যদিকে বিএনপি সংলাপে গিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন না করার মনোভাব দেখিয়ে এলেও তারা একটা পথ খোলা রেখেছে। সেটা হলো তারা এর আগে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা ঘোষণা দেওয়ার কথা বললেও তারা ঘোষণা দেয়নি। আমরা আশা করব, তারা এটা দেবে। কিন্তু আশঙ্কাও আছে, শেষ পর্যন্ত তারা এটা দেবে কি না।

আমাদের বিরোধী দল সাধারণত একটা বিজয় মিছিলের মাধ্যমে নির্বাচনে যেতে আগ্রহী। সে জন্য তারা মুখে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বললেও আসলে তারা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিধ্বস্ত ও ক্লান্ত দেখতেই ওত পেতে থাকে। খালেদা জিয়া যদি ঐক্যের কথা বলেন, তাহলে তঁাকে বিজয় মিছিলের আশা ত্যাগ করতে হবে। ক্ষমা না চাইতেও ক্ষমা করার রাজনীতির চেয়ে এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তঁার ক্ষমা করার অর্থ যদি এই হয় যে তিনি রাজনীতির অঙ্গনকে প্রতিশোধমুক্ত দেখতে চান, তাহলে স্বাগত জানাব। কিন্তু দেশের প্রচলিত আইন ও আইনের শাসনের যে মানদণ্ড, তা থেকে তঁার দায়মুক্তি দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। গণতন্ত্র সেটা দাবি করে না। যথাযথ আচরণ করতে হবে। যুদ্ধসহ সব অবস্থায় মানবাধিকারের শর্ত মানতে হবে। রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে সরকারি ক্ষমতার ব্যবহার করা যাবে না। শুধু এইটুকু মানলেই হলো।

এবারের বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে পথে পথে বাধা দেওয়ার নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে। আশা করব, এর পরে যেদিন বড় সমাবেশ হবে, সেদিন এই দৃশ্যটুকুও বাদ যাবে। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কারা বাধা দিল তা তঁারা চিহ্নিত করবেন। এখন তিনি যদি আন্তরিক হন, তাহলে তিনি একটি তদন্ত কমিটির ঘোষণা দেবেন, তাহলে তা সরকারি দলের ভাবমূর্তি উন্নত করতেই সহায়ক হবে।

বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। এ রকম ঐক্যের কথা আমরা জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন-পরবর্তী রাজনীতিতে প্রায়ই শুনতে পেতাম। সেসব শূন্যগর্ভ ছিল, কিন্তু ২০০৬ সালের পর একটা দীর্ঘ সময় এই ঐক্য তৈরির কথা রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হয়েছিল। এখন এটা বেগম খালেদা জিয়া জোরেশোরে বলছেন। কিন্তু অতীতে তা কেন কোনো ধরনের ভালো ফল বয়ে আনেনি, সেটা বিবেচনা না করে যদি বলার জন্য বলা হয়, তাহলে আমরা আবারও হতাশ হতে পারি। অবশ্য আপাতত চাইব রাজনীতিতে এর উচ্চারণ চলতে থাকুক।

খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে এক হতে হবে। এ ধরনের কথাবার্তা মেঠো বক্তৃতার দুর্নাম ঘোচাতে পারে, যদি একটি-দুটি বিষয় নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করা, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে নগর সরকারের রূপরেখা দিয়ে আওয়ামী লীগকে চিঠি দেওয়া। এখনই চিঠি দিতে হবে না। আপাতত নির্দিষ্টভাবে কোনো জনসভা বা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানালেও চলবে। বিএনপির বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কেন মতৈক্য আশা করবে না? এখন এটা তো বায়বীয় অবস্থা। একে অবয়ব দিতে চাইলে বলতে হবে, আমরা স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও যা করতে পারিনি, আসুন, এখন উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে একটি নির্দিষ্ট আইন তৈরি করি। বিএনপি যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে আগের মতো আর নেই, সেটা এ রকম প্রস্তাবের মাধ্যমে তারা জানান দিতে পারে। কতিপয় নির্দিষ্ট বিষয়ে (শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতি) আওয়ামী লীগের কাছে নির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরে তার অনুকূলে সমর্থন চাইতে হবে। বিএনপিকে বলতে হবে, এটা আওয়ামী লীগই বাস্তবায়ন করুক। যা পরিবর্তন চাই, তা বাস্তবায়নে নিজ দলকেই ক্ষমতায় বসতে হবে, সেটা যুক্তি নয়। বিএনপি বলুক, বিচারক নিয়োগ আইন করুন, আমরা বাইরে থেকে সমর্থন দেব। বেকারদের জন্য এই স্কিম দিলাম, বাস্তবায়ন করুন।

এরশাদের আমল থেকে ঐক্য শুনছি। কিন্তু এটা বলতে রাজনীতিকেরা কী বোঝান, আমরা বুঝি না। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া সারা দেশের নেতা-কর্মীদের নতুন কী বলেছেন, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বলে নেতা-কর্মীদের আন্দোলনে নামার ইঙ্গিত দিলেন কি না বোঝা গেল না। তবে তঁার মুখে আওয়ামী লীগকে ‘শুদ্ধ করা’ ও ‘মানুষ করার’ অঙ্গীকার অনেকে রসিকতা হিসেবেও নিতে পারেন। কেননা, অপরকে শুদ্ধ করার কথা বলার আগে নিজের দলের শুদ্ধতার দিকেও একবার তাকাতে হয়। ‘আপনি আচরি ধর্ম’ পরকে শেখাও।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷