মানোন্নয়নে চাই উদ্ভাবনের সুযোগ

শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিবছর জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শরীফ উল ইসলাম ২০১৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়েছেন। তরুণ এই শিক্ষা কর্মকর্তা তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী নানা উদ্যোগের সুবাদে দেশের অনেকের কাছে বেশ পরিচিত। লেখাপড়ার মতো গম্ভীর বিষয়কে আনন্দময় করে তুলতে নানা কৌশল উদ্ভাবন করে সেগুলো বাস্তবায়ন করেছেন শরীফ। তাঁর ভাবনা থেকে গড়ে ওঠা ‘আমার-স্বপ্ন-আমার-স্কুল’ উদ্যোগের মাধ্যমে নতুন বছরের পাঠ্যবই দেওয়ার উৎসব ‘শিশুবরণ’ উদ্‌যাপিত হচ্ছে স্কুলে স্কুলে, ছাত্রছাত্রীরা দেয়ালিকা প্রকাশ করছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য পড়ুয়ারা পাচ্ছে ‘স্মাইল কার্ড’। আবার শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবাই যাতে সময়মতো উপস্থিত হন, সে জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক ও এলাকার মানুষের আর্থিক সহায়তায় বায়োমেট্রিক হাজিরার যন্ত্র কিনে স্কুলে বসানো হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য বিষয়ে নানা পরামর্শ দেওয়ার জন্য তাদের মধ্য থেকেই ‘খুদে ডাক্তার’ তৈরি করা হচ্ছে।

শরীফ উল ইসলামের মতো উদ্যমী তরুণদের কাজের স্বীকৃতি লাভ স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাকর্মীদের আনন্দিত করে। তবে খুশির কারণ শুধু শরীফের মতো তরুণদের উদ্ভাবন নয়, বরং এসব উদ্ভাবন ছড়িয়ে দিতে সরকারের উদ্যমী ভূমিকাও। শরীফের উদ্যোগগুলো তাঁর সাবেক কর্মস্থল মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে চালু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও ছড়িয়ে পড়বে।

শিক্ষার মান এবং শিক্ষা খাতের ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে উদ্ভাবনী উদ্যোগ কাজে লাগানোর লক্ষ্য নিয়ে সরকার ২০১৩ সাল থেকে বিশেষ কার্যক্রম শুরু করে, যা সরকারি শিক্ষা কর্মকর্তা বা সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুধু নন, আমরা যাঁরা বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষা প্রসারের কাজ করছি, তাঁদের জন্যও উৎসাহব্যঞ্জক। এর ফলে উদ্ভাবনমূলক উদ্যোগ প্রসারে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা ও সমন্বয় আরও শক্তিশালী করার পথ সুগম হবে।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, ২০১৬ সালে দেশে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ। এ বছর (২০১৭) কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতির পর এই সংখ্যা আরও বাড়বে। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য সমমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে পাঠ্যক্রম, পাঠদান পদ্ধতি, শিখন প্রক্রিয়া ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা—এই চার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা দরকার। এসব পরিবর্তন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে প্রয়োজন উদ্ভাবনী মনোভাব, ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ এবং সফল উদ্ভাবনগুলোকে বড় বা জাতীয় পরিসরে প্রয়োগের জন্য সমর্থন ও সম্পদের জোগান। সরকারি পর্যায়ে, বিশেষ করে উদ্ভাবনের ওপর সাম্প্রতিক কালে মনোযোগ বৃদ্ধির পর থেকে এ-সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা জোরেশোরে হচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ৩২টি নানা ধরনের উদ্ভাবনী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলোর কয়েকটিতে অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্তও করা হয়েছে।

বেসরকারি পর্যায়েও শিক্ষার মানোন্নয়নে চলছে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা। এগুলোর জন্য সরকারি সমর্থন, সম্পদের জোগান ও সমন্বয় দরকার। ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিকের পাঠ্যক্রমভিত্তিক ‘মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল কনটেন্ট’ তৈরির সরকারি প্রকল্পে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ও সেভ দ্য চিলড্রেন যুক্ত হয়। প্রকল্পের আওতায় ২১টি পাঠ্যবই ও সহায়ক পাঠ উপকরণ ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তর করার ফলে এখন দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে এসব পাঠ্যবই ও উপকরণ সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা মডেল তৈরি প্রসঙ্গে ব্র্যাক প্রবর্তিত ঝরে পড়া এবং কখনো বিদ্যালয়ে যেতে না পারা শিশুদের জন্য এক কক্ষ-একজন শিক্ষক মডেলটির কথা বলা যায়। স্বল্প খরচের এই বিদ্যালয়টি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষাবঞ্চিত হাজার হাজার শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি। বিদ্যালয় বিস্তৃতির পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মানও নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী মাধ্যমিক বা তারও পরবর্তী পর্যায়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। স্বল্প পরিসর, স্বল্প খরচ ও স্বল্প জনবল দিয়ে মানসম্পন্ন বিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার এই অভিজ্ঞতা আমরা নিয়ে গেছি আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, উগান্ডাসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। সেখানকার পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্র্যাকের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা সেখানে নতুন বিদ্যালয় মডেল উদ্ভাবনে সে দেশের জনগণ ও সরকারকে সাহায্য করছি। আবার বিদেশে উদ্ভাবিত মডেল নিয়েও ব্র্যাক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এর একটি জাপানে উদ্ভাবিত ইংরেজি ও অঙ্ক শেখার সহায়ক পদ্ধতি ‘কুমন’, যার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সম্প্রতি দুটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

২০১৩ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাত্র ২৫ শতাংশের বাংলা বিষয়ে উপযুক্ত জ্ঞান এবং মাত্র ৩৩ শতাংশের গণিত বিষয়ে উপযুক্ত জ্ঞান রয়েছে। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশের বাংলা বিষয়ে, ৪৪ শতাংশের ইংরেজি ও ৩৫ শতাংশের গণিত বিষয়ে উপযুক্ত জ্ঞান রয়েছে। চিত্রটি মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়।

তবে গুণগত মানের শিক্ষায় বাংলাদেশই যে শুধু পিছিয়ে আছে তা নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, আফ্রিকার উপসাহারা অঞ্চলের দেশগুলো, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশও আজ একই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী ১ কোটি ৩০ লাখ শিশু স্কুলেই যেতে পারছে না। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়ন নিয়ে এসব দেশে চলছে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মডেল উদ্ভাবনের চেষ্টা।

তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে চিন্তাভাবনা বিনিময় দ্রুত করা সম্ভব হচ্ছে, বিশ্বের এক প্রান্তের উদ্ভাবিত মডেল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে আরেক প্রান্তে। বাংলাদেশের উদ্ভাবকেরাও আর এর বাইরে নেই। তবে ভাবনা, চেষ্টা ও উদ্ভাবন বিনিময়ের সুযোগ আমাদের দেশে আরও অবারিত হওয়া উচিত, তরুণদের আরও সম্পৃক্ত হওয়া এবং সরকারের আরও সমর্থন প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষাবিষয়ক উদ্ভাবনগুলো আমাদের দেশে আরও দৃশ্যমান করতে ব্র্যাকের উদ্যোগে ৯ থেকে ১১ নভেম্বর একটি আন্তর্জাতিক উদ্ভাবক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে এই বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলো এই উদ্যোগে শামিল ছিল। আমাদের আশা, ব্র্যাকের এই উদ্যোগ ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নিতে শামিল হবেন আমাদের অন্য অংশীজনেরাও।

ড. সফিকুল ইসলাম: পরিচালক, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি।

প্রিসিলা রাজ: সিনিয়র ম্যানেজার (যোগাযোগ), ব্র্যাক।