নির্বাচন নিয়ে ছেলেখেলা

আমরা জাহাজের ওপরতলায় খাবার ঘরে বসে কথা বলছি। আলাপের একপর্যায়ে যোগ দিলেন এক ভদ্রলোক। নাম বলাতে বুঝলাম তিনি ‘হিন্দু’ সম্প্রদায়ের সদস্য। বাড়ি সন্দ্বীপে। চট্টগ্রামের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ১৯৮৫ সালের ১৫ মে ২৫১টি উপজেলায় এবং ২০ মে ২০৯টি উপজেলায় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ। তবু সাধারণ মানুষ ওই নির্বাচন বর্জন করেনি। ওই সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এরশাদবিরোধী আন্দোলন চালু থাকলেও তাদের নির্বাচন বর্জনের ডাকে মানুষ তেমন কান দেয়নি। নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে হলেও এরশাদের তৈরি জনদল ১৯০টি উপজেলায় ‘জয়’ পেয়েছিল। কিন্তু এখানে কোন দল কয়টা উপজেলায় জিতেছিল তা মুখ্য বিষয় নয়। বিষয় অন্য কিছু।

আলাপের একপর্যায়ে স্কুলশিক্ষক উপজেলা নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি আর হাঙ্গামার কথা বললেন। তিনি রাউজানে একটি ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন। ওটা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এলাকা। সাকার লোকেরা তাঁকে বেদম পিটিয়েছিল এবং ইচ্ছেমতো ব্যালটে সিল দিয়ে ভোটের বাক্স ভরেছিল। তিনি তাঁর শার্ট খুলে দেখালেন পিঠে লাঠির আঘাতের চিহ্ন। রক্ত শুকিয়ে কালো দাগ বসে গেছে। সাকা সম্পর্কে তখন একটা জনশ্রুতি ছিল। তাঁর এলাকায় ‘হিন্দু’ সম্প্রদায়ের সদস্য অনেক। ভোটের রাজনীতিতে তাঁরা সাকার জন্য নির্ভরযোগ্য নন। তবে সাকাকে ভয় পান সবাই। সাকা গ্রামে গ্রামে গিয়ে সভা করেন আর বলেন, আপনারা কি আমার পছন্দের লোককে ভোট দেবেন না? সবাই হাত তুলে বলতেন, নিশ্চয়ই দেব। তখন সাকা বলতেন, আমি তো আপনাদের ভোট পেয়েই গেছি, ভোটের দিন কষ্ট করে আপনাদের আর ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই। সাকা এভাবেই নির্বাচনী বৈতরণি পার হতেন।

‘হিন্দু’ সম্প্রদায় এ দেশের নির্বাচনের রাজনীতিতে রীতিমতো জিম্মি হয়ে আছে দশকের পর দশক। কোনো কোনো দলের কাছে তারা অপাঙ্‌ক্তেয়, কারও কারও কাছে তারা ‘ভোটব্যাংক’। একটি বড় দল তো তাদের ‘স্থায়ী আমানত’ হিসেবেই বিবেচনা করে। এর রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দিকটির মাজেজা বোঝা কঠিন নয়। নির্বাচন কাছে এলে এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অস্বস্তি কিংবা আতঙ্কে থাকেন।

চারদিকে শোর উঠেছে, ২০১৮ সালের শেষ দিকে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে, তৈরি হচ্ছে নানা রকম সমীকরণ। একই সঙ্গে চলছে আন্দাজনির্ভর হিসাব এবং গুজব তৈরি। জনমনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। যেমন আদৌ কি নির্বাচন হবে? নির্বাচন হলে কি সব দল তাতে অংশ নেবে? সব দল অংশ নিলেও নির্বাচন কি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে? জয়-পরাজয় কি ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে আছে? ইত্যাদি। গুজব তো শুধু শুধু তৈরি হয় না, তার জন্য উর্বর জমি চাই। নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ তৈরির শর্তগুলো যেন তৈরি হয়েই আছে। গত সাড়ে চার দশকের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা তো সুখকর নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের গণপরিষদ অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে আট মাসের মধ্যে একটি সংবিধান দিয়েছিল আমাদের। এটা ছিল এক অনন্য অর্জন। গণপরিষদে বাহাত্তরের নভেম্বরে নতুন সংবিধান পাস হওয়ার পরপর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে এবং সংসদ ভেঙে যায়। নতুন একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় এবং ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

আওয়ামী লীগ ছিল দেশের সবচেয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক দল। নির্বাচনে এই দলটির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না। তথাপি অন্য দলের প্রার্থীরা যাতে নির্বাচিত না হতে পারেন, সে জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হয়। ইতিমধ্যে নয়জন ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা হলেন সোহরাব হোসেন, তোফায়েল আহমেদ, মোতাহার উদ্দিন, কে এম ওবায়দুর রহমান, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, মনোরঞ্জন ধর, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান। কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল।

নির্বাচনের দিন তথ্য সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিলেন অনেক সাংবাদিক। তাঁদের একজন হলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। কাজ করেন সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসে। তিনি তাঁর ওই দিনের অভিজ্ঞতার বয়ান দিয়েছেন এভাবে:

‘৭ মার্চের নির্বাচনের দিনের ঘটনা ছিল লজ্জাজনক ও হাস্যকর। বিকেল পাঁচটা থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষে নির্বাচনের ফলাফল আসছিল। উপস্থিত শত শত কর্মকর্তা ও সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রাত নয়টার দিকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে এঁরা জিতে গেছেন, যেমন ন্যাপ (ভাসানী) থেকে আলীম আল রাজী, আবদুর রহমান, মসিয়ুর রহমান (জেলে থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন), রাশেদ খান মেনন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (ন্যাপ-মোজাফফর); জাসদের শাহজাহান সিরাজ, এম এ জলিল ও আবদুস সাত্তার। এ ছাড়া ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং মুশতাক আহমদ চৌধুরী আর জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান বিপুল ভোটে এগিয়ে ছিলেন। এমনকি টেলিভিশনে তাঁদের কয়েকজনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল। রাত ১০টার দিকে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখার নির্দেশ আসে।’ (সূত্র: সৈয়দ আবুল মকসুদ, ভাসানী, ১৯৮৬: উদ্ধৃতি দিয়েছেন এস এ করিম, শেখ মুজিব: ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি, ২০০৫)।

সৈয়দ আবুল মকসুদ অবশ্য ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের’ ব্যাখ্যা দেননি। সে যাহোক, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার শুরুটা ভালো হয়নি। ১৯৭২-৭৫ সালে এ দেশে গণতন্ত্রের উত্থান ও পতন লক্ষ করা গেছে। এ সময়ের একটি মূল্যায়ন পাওয়া যায় জাসদ-গণবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ও বর্তমানে জাসদের একটি অংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর এক লেখায় (তিন দাগে ঘেরা বাংলাদেশ, ২০০২)। সেখানে তিনি সংবিধানের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সংশোধনীর সমালোচনা এবং নির্বাচন ছাড়াই রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সমালোচনা করেছেন। ইনু এখন আওয়ামী নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের তথ্যমন্ত্রী। তিনি সাবেক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দিক থেকে কামানের নলটি ঘুরিয়ে বর্তমানের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অবিরাম গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছেন। রাজনীতিতে শত্রু-মিত্র চিরস্থায়ী হয় না।

১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট লুটের নতুন এক ইতিহাস তৈরি হয়েছিল। বিএনপি এবং তার ডান-বাম মিত্ররা নির্বাচন বর্জন করায় আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠ পেয়ে গিয়েছিল। প্রায় সব জায়গায় ছিল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জয়জয়কার। তারপর দেখা গেল, হঠাৎ করে টেলিভিশনে ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করে দেওয়া হলো। নির্বাচনের ফল পাল্টে দেওয়া হলো আমূল। ‘মিডিয়া ক্যু’ শব্দটি চালু হয় ওই সময়। নির্বাচনপ্রক্রিয়াটি ধ্বংস করার আয়োজন এরপরেও অব্যাহত থাকে। টাকা দিয়ে ভোট কেনা, মাস্তান দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল এবং লাখ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে ভোটার তালিকা সাজিয়ে পরবর্তী নির্বাচনগুলোকে হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার নাটকটি আমরা মঞ্চস্থ হতে দেখেছি বারবার।

এখানে একটি কথা না বলে পারছি না। ষাটের দশকে আইয়ুব-মোনায়েমের স্বৈরশাসনের সময় ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশনকে (এনএসএফ) পুষত ক্ষমতাসীনেরা। তারপরও দেখা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো এবং এনএসএফ বেশি সুবিধা করতে পারত না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে ডাকসু নির্বাচন পণ্ড করে দেওয়ার নজিরটি প্রথম স্থাপিত হয় ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে। জাসদপন্থী ছাত্রলীগের মাহবুব-জলুর পরিষদ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখনই ছাত্র ইউনিয়ন আর সরকার সমর্থক ছাত্রলীগের যৌথভাবে দেওয়া লেনিন-গামা পরিষদের লোকেরা সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন কখনোই ডাকসু নির্বাচনে জেতেনি।

১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে প্রায় জিতে যাওয়া ওই সময়ের সবচেয়ে সাহসী ও জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আ ফ ম মাহবুবুল হক সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। অর্থনীতি বিভাগের এই মেধাবী ছাত্রের নিশ্চিত বিজয় সেদিন নিষ্ঠুরভাবে ছিনতাই করা হয়েছিল। তা না হলে আজ আমরা বলতে পারতাম, ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি, আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মাহবুব পরে জাসদ ও বাসদের রাজনীতি করেছেন। কয়েক বছর আগে এক রহস্যজনক দুর্ঘটনায় তিনি স্মৃতিশক্তি হারান। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।