তারুণ্যের বিসিএস উন্মাদনা, সমস্যা যেখানে

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উপাত্ত মতে, বাংলাদেশের শ্রমশক্তি বছরে গড়ে ২ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০১০ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিসিএসে আবেদন করার যোগ্য স্নাতক ডিগ্রিধারীদের বাৎসরিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের মতো (বিবিএস)। অথচ গত ১০ বছরে বিসিএসে আবেদনের গড় বাৎসরিক প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের কাছাকাছি। আর ৩৮তম বিসিএসে আগের বিসিএসের তুলনায় প্রায় এক লাখ, অর্থাৎ শতকরা ৪২ ভাগ বেশি আবেদন পড়েছে। আশা করি, এটাকে তরুণ প্রজন্মের বিসিএস উন্মাদনা বললে অত্যুক্তি হবে না। এর পেছনে সম্ভাব্য কিছু কারণ আছে নিশ্চয়ই।

সরকারের নবম পে-স্কেলে মূল বেতন ৯১ শতাংশ থেকে ১০১ শতাংশ এবং অন্যান্য ভাতা বাড়ার কারণে সরকারি চাকরিতে আবেদনের একটা আর্থিক প্রণোদনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ২০০৯-এ প্রণীত বেতনকাঠামোতে বেতন বৃদ্ধির পরও ২৯তম ও ৩০তম বিসিএসে এই ধরনের বিসিএস উন্মাদনা দেখা যায়নি, যদিও বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ তখন তুলনামূলকভাবে একটু কম ছিল। স্নাতকধারীদের সংখ্যা যেহেতু গড়ে ১০ বছরে ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে, সেই তুলনায় বছরে বিসিএসে আবেদনের প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক। তাহলে বেতন বৃদ্ধির জন্য সরকারি চাকরিতে অস্বাভাবিক আকর্ষণ তৈরি হয়েছে অথবা আর্থিক প্রণোদনার বাইরে অন্য কোনো সুবিধা এখানে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে। স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক মর্যাদা এখানে বড় ভূমিকা রাখে।

রাষ্ট্র যদি সরকারি পেশায়, বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিসে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাখে, তাহলে সামগ্রিক সমাজকাঠামো ও অর্থব্যবস্থায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আমরা বৈষম্য বলতে এককথায় অর্থনৈতিক বৈষম্য বুঝে থাকি। এর বাইরে বৈষম্যের একটা বিরাট জগৎ আছে। অর্থনৈতিক সুবিধা থাকার পরও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি অনার্থিক বৈষম্যের কারণে জৌলুশ হারাচ্ছে। আর সামাজিক মর্যাদা বা স্ট্যাটাস জিনিসটা অনার্থিক সুবিধা দ্বারা দিনকে দিন বেশি মাত্রায় প্রভাবিত হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে নেতিবাচক আর্থিক বৈষম্য থাকার পরও যদি সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় পুঁজি চাকুরেদের কাছে আরও পুঞ্জীভূত হয়, তাহলে তাঁরা সরকারি চাকরিকে প্রাধান্য দেবেন। আপাতদৃষ্টিতে সম্প্রতি অতিমাত্রায় বিসিএস উন্মাদনা মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক পুঁজির বৈষম্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী তরুণেরা নিজ নিজ বিশেষায়িত পেশা ছেড়ে স্বেচ্ছায় কিংবা সমাজ-পরিবারের ইচ্ছায় ক্যাডার সার্ভিসের একটা চাকরির জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠছে, পরিণামে এই বৈষম্য আরও বাড়ছে। যে ক্যাডারে যত বেশি সামাজিক ও রাজনৈতিক পুঁজি হাতের মুঠোয় পোরার সুযোগ রয়েছে, সেই ক্যাডারের জন্য আগ্রহ তত বেশি। প্রথমবার দুই বছরের বেশি সময়ের চেষ্টার পরও কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার না পেলে এই স্নাতকধারীরা সামনের বিসিএসগুলোতে আবার চেষ্টা করছে, এর ফলে অনেক শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এর সুদূরপ্রসারী সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব আছে। সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক পুঁজির বৈষম্যের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পুঁজির বৈষম্য আলোচনায় আসবে। আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার পরও জাতীয় অর্থনীতির পাঁচ ভাগের চার ভাগ দখল করে রাখা বেসরকারি খাত যোগ্য ও মেধাবী তরুণদের বড় একটা অংশকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হবে—এমন আশঙ্কা রয়েছে। ফলে উৎপাদনমুখী খাতগুলো চাকরির বাজারে জৌলুশ হারাচ্ছে। প্রকৌশলী হয়ে যাচ্ছেন স্রেফ একজন আমলা। শিক্ষা খাতে জনগণের করের টাকার অপব্যবহার হচ্ছে। আর স্নাতকধারী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়ছে। বিবিএসের তথ্যমতে, গত ছয় বছরের তিনটা শ্রমশক্তি জরিপে এই হার ১০ শতাংশের ওপরে, যা অন্যান্য পর্যায়ের শিক্ষিতদের চেয়ে অনেক বেশি। পূর্ণকালীন শ্রমঘণ্টার হিসাব করলে এই হার আরও বেশি হবে।

অনুন্নত দেশগুলোতে সরকারি চাকরির জন্য বেশি আগ্রহ দেখা যায়। উন্নয়নশীল দেশগুলো যত উন্নতি করে, সরকারি চাকরিতে প্রতিযোগিতা তত কমে যায়। এর পেছনে উন্নয়নের ইতিহাস-সম্পর্কিত কিছু কারণ রয়েছে। দেশ যত অনুন্নত হয়, চাকরির বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের পরিধি তত ছোট থাকে এবং প্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোর মধ্যে সরকারি খাতের উপস্থিতি তত বেশি হয়। বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপগুলোর উপাত্ত মতে, গত ১৫ বছরে শ্রমবাজারে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের দখল ছিল ৮০ শতাংশের কাছাকাছি এবং স্ব-কর্মসংস্থানের হার ৪০ শতাংশের ওপরে। জিডিপিতে সরকারি খাতের অবদান অনেক কম হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারে সরকারি খাতের অংশীদারি আরও বেশি হবে। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে আকাশছোঁয়া প্রতিযোগিতার পেছনে কারণ হিসেবে সামাজিক মর্যাদার পাশে যোগ হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক চাকরির চাহিদা। কিন্তু সবকিছুর পরও দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতের অবদান বেশি। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে আরও এগিয়ে নিতে হলে তারুণ্যের মেধাশক্তির বড় একটা অংশ বেসরকারি খাতে, বিশেষ করে উৎপাদনশীল খাত ও সেবা খাতের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। সরকারি চাকরিতেও মেধার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু এ নিয়ে বিপুলসংখ্যক তারুণ্যের উন্মাদনা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অকল্যাণকর। একটা পদের বিপরীতে হাজারসংখ্যক আবেদন কাম্য নয়, এতে নিয়োগপ্রক্রিয়াও অদক্ষ ও দীর্ঘ হয়ে যায়। স্নাতকধারীরা একটা সরকারি শোভন চাকরির অপেক্ষায় মূল্যবান সময়ের একটা বড় অংশ নষ্ট করে ফেলে।

এখন প্রশ্ন, তাহলে কীভাবে বিসিএস-উন্মুখ তরুণদের একটি অংশকে বেসরকারি ও বিশেষায়িত দক্ষতামূলক পেশায় উৎসাহিত করা সম্ভব? এটাকে ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে হবে। ব্যক্তি চলমান ধারার নিরিখে নিজের জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্পটা বেছে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। চেতনা, দেশপ্রেম এখানে নগণ্য ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে আমাদের দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে। কোনো স্নাতক তরুণের পরিবার যদি গ্রাম্য মোড়ল-মাস্তানের দ্বারা নিত্য নাজেহাল হয়, তাহলে তার জন্য টাকা ছাড়াও ক্ষমতা বড় একটা বিষয়। কিংবা যদি এমন হয় যে বাবা তাঁর মেয়েকে বেসরকারি কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে দেবেন না, তাহলে তরুণের জন্য সরকারি চাকরি নির্বিকল্প হয়ে পড়ে! অর্থাৎ বেসরকারি খাতের চাকরিতে তারুণ্যকে উৎসাহিত করতে হলে সমাজের কিংবা সমাজের কতিপয় মানুষের রোগ সারাতে হবে। আইনের চোখে সবাই সমান হলে গ্রাম্য মোড়ল-মাস্তানের কথা ক্যারিয়ার বাছাইয়ের সময় বিবেচনা করতে হতো না। সরকারি চাকরিতে অবৈধ কিংবা বৈষম্যমূলক ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ না থাকলে তরুণেরা এর জন্য এত উন্মুখ হতো না। মেয়েদের জন্য বেসরকারি চাকরি আরও অনাকর্ষণীয়। কারণ, সরকারি খাতে তাদের জৈবিক গঠনের অনুকূলে যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, বেসরকারি খাতের অনেকাংশে সেগুলো নেই। কিংবা সেখানে এগুলো পেতে কাঠখড় পোড়াতে হয়। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নারীদের এসব সুবিধা দেয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

চাকরির সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু ব্যক্তির সঙ্গে অসম্পর্কিত বিষয়গুলোর প্রভাব থেকে ব্যক্তিকে মুক্ত রাখা গেলে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যেটা কল্যাণকর, ব্যক্তি সেটাই বেছে নেবে। নীতি প্রণয়নের সময় বেসরকারি খাতের চাকরিতে উৎসাহিত করার মতো সমন্বিত নীতি প্রণয়ন করতে হবে। সরকারি চাকুরেদের প্রণোদনা দেওয়ার সময় নজর রাখতে হবে, যাতে বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতায় সক্ষম প্রতিষ্ঠানে অনুরূপ বা কাছাকাছি সুবিধা দেওয়া হয়; অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত অসমতা যেন সৃষ্টি না হয়। সর্বোপরি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে, তা না হলে বাজারের কাঙ্ক্ষিত ফলকে ‘বাজার প্রক্রিয়া নিঃসৃত ফল’ হিসেবে পাওয়া যাবে না। বাজার ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত ফলপ্রাপ্তির জন্য যে পরিবেশ দরকার, সেটা নিশ্চিত করা দরকার। এই পরিবেশ সরকারের নীতিনির্ধারকেরাই নিশ্চিত করতে পারেন। কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে হয়তো সমাজের ‘শোভন পেশার’ সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হবে, নয়তো অশোভন পেশাকে শোভন করতে হবে।  

শহিদুল ইসলাম: গবেষণা সহযোগী, বিআইডিএস।