'সুফিয়া কামাল মঞ্চ' হোক ঘরে ঘরে

সুফিয়া কামাল
সুফিয়া কামাল

১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর খুব ভোরবেলায় মাটির পৃথিবী ছেড়ে আপনি চলে গেলেন। আমরা জানতাম, বিপদ আমাদের ঘিরে দাঁড়াবে। আবার এ-ও জানতাম যে সেই বিপদে আপনিই সহায়।

মৃত্যুর মাত্র কদিন আগে নভেম্বর ’৯৯-এর ১ বা ২ তারিখ আপনি একটা ছেঁড়া ছোট্ট চিরকুট পাঠিয়েছিলেন। (কার হাত দিয়ে পেয়েছিলাম মনে নেই), ‘মালেকা আসবে, দেরি হলে আর দেখা পাবে না।’ এই চিঠিটা পাওয়ার স্মৃতি আজও আমাকে কাঁদায়।

ছুটে গেলাম, আপনি দুহাতে জড়িয়ে দুই গালে চুম্বন দিয়ে বললেন, ‘আমার দোয়া, দুর্গত মেয়েদের পাশে থেকো, ওদের জন্য সুন্দর জীবন গড়ার সংগ্রাম থেকে সরে যেয়ো না।’

খালাম্মা, আপনার সেই দোয়া-চুম্বন মাথায় নিয়ে আজও চেষ্টা করতে চাই, ওদের পাশে থাকতে চাই—কিন্তু জলোচ্ছ্বাসের মতো ঘটে যাওয়া নারী-দুর্গতি থামবার তো লক্ষণ নেই। তাই প্রচণ্ডভাবে আপনার অভাব বোধ করি। আপনি যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেই আন্দোলনের পতাকা ধরে রাখতে পারলাম না।এই লজ্জা ও হৃদয়বিদারক আর্তি প্রতিদিন আমার এবং আমাদের সবারমাথা নত করে দেয়। ক্ষতবিক্ষত করে দেয় আমাদের হৃদয়।

আপনি কী করতেন এই দুর্গত সময়ে? সেই মিছিলের প্রথমে থেকে আমাদের বলতেন ‘মানববন্ধন’ তো ফাঁকি দেওয়ার কৌশল, মিছিলে চলো নারী-পুরুষ সবাই। আসুক ঝড়-ঝাপটা, বাধা দিলে বাধবে লড়াই।

খালাম্মা, এখন প্রতিদিন মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে শিক্ষাকেন্দ্র—স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাদ্রাসায়। পথে-ঘাটে, বাড়িতে, কাজের জায়গায়, বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে, খোলা জায়গায়, পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলে। কী করব আমরা? আপনি কী করতেন এই সময়ে?

প্রতিদিন খবরে জানছি পথে-ঘাটে মেয়েদের যৌন হয়রানির কথা। তালাকপ্রাপ্ত স্বামীর অত্যাচার ও ‘গণযৌন হয়রানি’র অপরাধ গণমাধ্যমে সংবাদ হয়ে প্রচারিত হচ্ছে। প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রচারণায় ছড়িয়ে পড়ছে মেয়েদের যৌন হয়রানির দৃশ্য।

আপনি কীভাবে এই অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন? আমাদের অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত আছে সেই সময়ের আন্দোলনের কথা। নারী-পুরুষ মিলে ঐক্যবদ্ধ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ প্রস্তুতি কমিটির ব্যানারেপ্রথিতযশা সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ যখন আপনার নেতৃত্বে গড়ে তুললেন জাতীয় আন্দোলন, তখন আমরা পাশে পেয়েছিলাম সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তসহ অনেককে। পাশে পেয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের। দেশজুড়ে সভায়-মিছিলে-স্লোগানে আপনি রুখে দাঁড়ানোর আওয়াজ তুলে আমাদের এগিয়ে যেতে বলতেন। এগিয়ে নিতেন।

আজ আমরা কেন প্রযুক্তির অপব্যবহারের অপরাধকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছি না? যারা ‘ফেসবুক’-এর পাতায় পাতায় এসব যৌন হয়রানির ছবি ছড়াচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন তাদের ধরতে পারছে না? কেন বলছে এসব ব্যক্তিগত বিষয়? কেন আমরা ‘সমাজ’কে দোষারোপ করি?

যদি আপনার আশীর্বাদ থাকে, এই দুঃসময়ে আমরা আবার রাজপথে নামব। ‘সুফিয়া কামাল প্রতিরোধ মঞ্চ’ গড়ে তোলার চষ্টা করব। আর সেটি শুরু হতে পারে ২০ নভেম্বর ২০১৭ থেকেই। আহ্বান জানাচ্ছি আপনার নামে; সবাই আসুন, যোগ দিন এই প্রতিরোধ মঞ্চে। মিছিলে, সভায়, জেলায়, শহরে, গ্রামে ইতিমধ্যে বাল্যবিবাহ বন্ধের আন্দোলন শুরু হয়েছে। আপনার নামে ‘প্রতিরোধ মঞ্চ’ থেকে নারী নির্যাতন বন্ধের আন্দোলন শুরু হোক।

প্রথম আলো ‘বন্ধুসভা’ গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। আমরা আপনার পক্ষে এই ‘বন্ধুসভা’র উদ্যোক্তা বন্ধুদের আহ্বান জানাচ্ছি—আসুন, সবাই মিলে নারী হয়রানির বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন গড়ে তুলি।

নির্যাতনকারী পুরুষ-নারীদের (কখনো কখনো নারীও নির্যাতনকারী হয়) বিরুদ্ধে ঘৃণা ও শাস্তির তর্জনী তুলতে হবে। বাড়িতে বাড়িতে মা-বাবা-অভিভাবকেরা নারী নির্যাতনকারী নিজ সন্তানদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান—এই আহ্বান জানাচ্ছি আপনার নামে।

১৯৭০ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন নারী সংগঠন যেসব নারীর লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে সরব হয়ে আইন প্রয়োগকারীদের বাধ্য করেছে দোষী-অপরাধীদের সাজা দিতে, এই শতকে সেই সব সংগঠন কেন কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারছে না? কেন ঘরে ঘরে সুফিয়া কামালের আদর্শের অনুসারী তৈরি করতে পারছি না আমরা?

আমরা নতুন করে আন্দোলন গড়ে তুলব। নারী নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক জাগরণ সৃষ্টি করব—এই শপথই হোক আপনার স্মৃতিভাস্বর স্মরণদিনে।

আপনি লিখেছিলেন ভোরের কাগজ পত্রিকায় ১৯৯৭ সালে; ঈদের বাজারে পাকিস্তানি লেহেঙ্গার দাম ১ লাখ ৪০ হাজার হওয়ার প্রতিক্রিয়া... ‘কালোটাকায় মুখ আলো হয় না।... আত্মমর্যাদা ধুলায় লুটাবেন না।’

১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত আপনার নেতৃত্বে ফতোয়ার প্রতিরোধে নারী-পুরুষ প্রগতির শক্তি পথে নেমেছিলেন। জাতীয় কবিতা উৎসবের উদ্বোধন করে আপনি ১৯৯৫ সালে তরুণ প্রজন্মের প্রতি বিভ্রান্তি ও ধর্মান্ধতামুক্ত থেকে সামাজিক অনাচার ও অসংগতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

আজ সেসব শুধু মনে করার দিন নয়, পালন করার দিন। আপনার কথা শিরোধার্য করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমরা পথে আছি, পথে থাকব।

মালেকা বেগম: চেয়ারপারসন, সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।