পোলট্রিশিল্পের আরও বিকাশ কীভাবে হবে

ষাটের দশকে সরকারি প্রচেষ্টায় দ্রুত বর্ধনশীল বা হাইব্রিড পোলট্রি অর্থাৎ হাঁস-মুরগি পালনকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা ব্যর্থ হলেও আশির দশকে তা বাস্তব রূপ নেয় এবং হাঁটি হাঁটি পা পা করে তা এগিয়ে চলে একটি শিল্পের রূপ নিতে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সরকারের বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উদ্যোগে পোলট্রিশিল্প গতি পায় এবং সস্তায় উন্নত আমিষের উৎস হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে পোলট্রিশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের আকার ধারণ করে এবং বছরে প্রায় ১৫-২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই শিল্প শিক্ষিত-বেকার ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করে ক্ষুদ্র খামার স্থাপনে এবং বৃহৎ বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করে হ্যাচারির মতো বড় বিনিয়োগে। নতুন শতকের শুরু পর্যন্ত শিল্পটি বৃদ্ধি পেতে থাকে কিন্তু হোঁচট খায় ২০০৪ সালে, যখন বিশ্বব্যাপী আবির্ভূত হয় এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু। ধসে পড়ে এই শিল্প। পরবর্তী পাঁচ বছরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে সম্ভাবনাময় এই শিল্প।

নানা গুজবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার এই শিল্প সরবরাহ করে চলেছে এ দেশের মানুষের জন্য সস্তায় উন্নতমানের আমিষ। পোলট্রিশিল্পকে কেন্দ্র করে সারা দেশে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় আকারের খামার, হ্যাচারি, ফিড মিল আর ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে এই শিল্পে। তবে সঠিক, সময়োপযোগী এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে না পারা এই শিল্পের বড় সমস্যা। এই শিল্পে সবচেয়ে বেশি টাকা ব্যয় হয় হাঁস-মুরগির খাবার কিনতে। এই খাবার মূলত আমদানিনির্ভর, যেমন: ভুট্টা, সয়াবিন মিল, প্রিমিক্স, এডিটিভের বড় অংশ আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া খামারে প্রয়োজনীয় ওষুধ, টিকা ইত্যাদি আমদানি করতে হয়। সুতরাং আমদানি পর্যায়ে পণ্য খালাসে দ্রুত সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া থমকে থাকে, যা একেবারেই কাম্য নয়।
এ সমস্যা সমাধানে এই মুহূর্তে প্রয়োজন সব মহলের সমন্বয়ে একটি প্রতিষ্ঠান বা পোলট্রি বোর্ড, যা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা পালন করবে। এই প্রতিষ্ঠানে থাকবেন সরকারের প্রতিনিধি, খামারির প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিনিধি। রোগবালাইগত সমস্যা অথবা বাণিজ্যিক সমস্যার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিয়ে এ বোর্ডকে কার্যকর করা গেলে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে এই শিল্প।

এ শিল্পের একটি বড় সমস্যা সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব। সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়া কোনো পরিকল্পনাই সঠিক ও বাস্তব রূপ নিতে পারে না। পরিসংখ্যানের জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত তথ্যের প্রবাহ এবং প্রাপ্ত তথ্যের সব মহলের গ্রহণযোগ্যতা। এই বোর্ডকে ক্ষমতা প্রদান করলে তথ্য সংগ্রহ করে একটি সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষণে সক্ষম হবে, যা উপকৃত করবে সবাইকে।

পোলট্রিশিল্পের অন্য একটি বড় সমস্যা হচ্ছে বাজারজাতকরণ। খামারি উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না বলে হতাশাগ্রস্ত হন। অনেকে মনে করেন যে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে খামারি ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। এ কথা যেমন সত্যি, আবার এই মধ্যস্বত্বভোগীরা খামারির বিনিয়োগের চালিকাশক্তি। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা বলে ক্ষুদ্র খামারিরা ব্যাংক অথবা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হন। আর তখন তাঁদের এসব মধ্যস্বত্বভোগীর দ্বারস্থ হতে হয়। খামারিরা তাঁদের কাছে খামারে উৎপাদিত পণ্যের, বিশেষভাবে ডিম অগ্রিম বিক্রি করেন এবং সেই বিনিয়োগে খামার পরিচালনা করেন। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র খামারিদের, কৃষি খামারিদের ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণের আওতায় এনে বিনিয়োগ-সহায়তা দিতে পারে, যা ক্ষুদ্র কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধযোগ্য হবে।

অন্যদিকে পোলট্রি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানের আড়তগুলোকে অতি অল্প বিনিয়োগে আধুনিক ট্রেডিং ফ্লোরে রূপান্তর করতে পারে, যেখানে থাকবে ঋণ প্রদানকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘বুথ’। খামারি তাঁর উৎপাদিত পণ্য, যেমন ডিম ও মাংস এই ট্রেডিং ফ্লোরে বাধ্যতামূলকভাবে বিক্রি করবেন এবং বড় ক্রেতা অথবা পাইকারেরাও এখান থেকেই পণ্য কিনবেন। লেনদেন হবে ব্যাংকের বুথের মাধ্যমে। অর্থাৎ ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করবেন বিক্রেতা বা খামারির অ্যাকাউন্টে। ব্যাংক খামারির জন্য নির্ধারিত কিস্তির টাকা কর্তন করে অবশিষ্ট টাকা বিক্রেতা বা খামারির অ্যাকাউন্টে জমা দেবে। এতে খামারি পাবেন তাঁর ন্যায্যমূল্য, ব্যাংক ফেরত পাবে তার বিনিয়োগ, হ্রাস পাবে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য এবং সর্বোপরি লেনদেনে আসবে স্বচ্ছতা।

মনে রাখা প্রয়োজন, পোলট্রি একটি জীবন্ত শিল্প এবং চাইলেই যখন-তখন বাচ্চা উৎপাদন করা যায় না। একটি হ্যাচারি থেকে এক দিনের বাচ্চা উৎপাদনের জন্য কমপক্ষে পাঁচ-ছয় মাস সময় প্রয়োজন হয়। সুতরাং বাজারে বাচ্চার চাহিদা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হ্যাচারি বাচ্চা উৎপাদন করতে পারে না। আবার বিভিন্ন সময়ে ভোক্তার চাহিদার জন্য খামারে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদার হেরফের হয়। যেমন রোজার সময় ডিম-মাংস উভয়ের চাহিদা কমে যায়, কোরবানির পরে প্রায় এক মাস ভোক্তা ডিম ও ব্রয়লার মাংস কম গ্রহণ করে। আবার বাজারে মাছের সরবরাহ বেড়ে গেলেও ডিম-মাংসের চাহিদা কমে যায়। যেহেতু বাচ্চা উৎপাদন এবং বাণিজ্যিক খামারের উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, সুতরাং একটি সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া শক্ত ভিত্তির পোলট্রিশিল্প অসম্ভব। পোলট্রি বোর্ড গঠন করে সঠিক বাজার পর্যালোচনা করার মাধ্যমে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারে সংশ্লিষ্ট সব মহল।

বাংলাদেশের পোলট্রিশিল্প মাটি ও মানুষের শিল্প। এ শিল্পকে ধরে রাখা সরকারি-বেসরকারি সব মহলের দায়িত্ব। সবাই মিলে একটি সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হলে দেশের মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে আমিষের চাহিদা যেমন পূরণ হবে, তেমনি ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বিনিয়োগের মাধ্যমে চলমান থাকবে দেশের অর্থনীতি।

মো. মোরশেদ আলম: কৃষিবিদ ও সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যানিমেল অ্যাগ্রিকালচার সোসাইটি।