কমে যাচ্ছে বিদেশি শিক্ষার্থী

একসময় এ দেশের উচ্চশিক্ষার পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার প্রসারে অবদান শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে তা বহির্বিশ্বেও পৌঁছে গিয়েছিল। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অনেক পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে জাপান, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইরান, কোরিয়া, ভারত, চীন থেকে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী পড়তে আসত। দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীর সমারোহে মুখরিত থাকত এসব বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। পাল্টে গেছে দৃশ্যপট, আমাদের শিক্ষার্থীরাই এখন ওই সব দেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান, রাজনৈতিক সহিংসতা, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কা বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহে ভাটার সৃষ্টি করেছে। ভিসা-সংক্রান্ত জটিলতা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ফাইলের গতি বাড়াতে কথিত স্পিড মানির প্রবণতা—এসব শিক্ষার্থীদের বিমুখ করছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বিষয়ভিত্তিক পরিপূর্ণ তথ্য না থাকায় এবং বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তিসংক্রান্ত তথ্য বা গাইডলাইন, হটলাইন ও হেল্প ডেস্ক না থাকায় আগ্রহী অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারছে না এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষা চালু করায় এবং সার্কভুক্ত দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০০ ডলার এবং অন্যদের জন্য ১০০০ ডলার ভর্তি ফি ধার্য করায় বিদেশি শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। অনেক সময় বাংলাদেশি ও বিদেশি লবিস্ট গ্রুপ বা কনসালট্যান্টের সহযোগিতা নিয়ে তারা এ দেশে ভর্তি হয়। এতে তাদের বাড়তি টাকা গুনতে হয় এবং কখনো প্রতারিত হতে হয়। এ ছাড়া ভর্তির সময়ের সঙ্গে বিদেশের ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ফলাফল বা সার্টিফিকেট প্রাপ্তির সমন্বয় না থাকায় এসব শিক্ষার্থী অনেক সময় এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্ধারিত সময়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না।

ইউজিসির ২০১৫ সালের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ৫৯৩ জন বিদেশি শিক্ষার্থী দেশের ১৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। এই সংখ্যা আগের বছরগুলোর তুলনায় কিছুটা কমবেশি হলেও পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির হার খুবই কম। বর্তমানে দেশে দুই হাজারের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী থাকলেও অধিকাংশই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তবে এই সংখ্যা পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের তুলনায় এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বর্ণযুগের সময়কার তুলনায় অনেক কম। গুটি কয়েক নতুন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পদচারণ দেখা গেলেও তাদের বেশির ভাগই আসে নেপাল, ভারতের কাশ্মীর, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলো থেকে। এসব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ নিম্নমানের। নামমাত্র টিউশন ফি এবং অনেকটাই বিনা খরচে আবাসিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অল্প খরচে লেখাপড়া করার বিষয়গুলো তাদের এখনো আকৃষ্ট করছে। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিকতা ও অতিথিপরায়ণতাও তাদের বিবেচ্য বিষয়।

ভর্তির ক্ষেত্রে একজন বিদেশি শিক্ষার্থীকে নিজ দেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস বা হাইকমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করতে হয়, সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনটি আসার পর প্রার্থী ভর্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হলে তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তি সনদ গ্রহণ সাপেক্ষে ভর্তি করে নেওয়া হয়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রার্থীকে সশরীরে হাজির হয়ে লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। এভাবে ভর্তিকৃত একজন শিক্ষার্থীকে নিজ দেশে ফিরে পুনরায় ভিসার আবেদন করতে হয়। অধিকন্তু, এসব শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশের ভিসা পেতে অধিক ফি, হয়রানি ও বিলম্বের শিকার হতে হয়। অথচ অন্য দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভর্তি-ইচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে অথবা কাগজপত্র পাঠিয়ে সরাসরি ভর্তি হতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে বিদেশি শিক্ষার্থীর পরিমাণ একটি অন্যতম উপাদান। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের আকৃষ্ট করতে হবে। সেকেলে সিলেবাস পরিবর্তন করে যুগোপযোগী শিক্ষা দিতে হবে। নতুন নতুন কোর্স চালু করতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অফিস থাকবে, যারা বিদেশি শিক্ষার্থীদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক আলোচনা সভায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরেন স্টুডেন্ট সেল গঠনের সুপারিশ করা হয়। বিদেশি ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে সার্কভুক্ত দেশগুলোর উচ্চমাধ্যমিক বা সমমান পরীক্ষার ফলাফল বা সনদপ্রাপ্তির সময়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ভর্তির সুযোগ প্রদান করা যেতে পারে। ভর্তির প্রক্রিয়া সহজ ও সাশ্রয়ী করতে অন্যান্য দেশের মতোই মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা বাদ দিয়ে সরাসরি ভর্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক আবাসিক ও নিরাপত্তাব্যবস্থা, টিউটর বা স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার রাখতে হবে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিনোদনের সুযোগ রাখতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি, কোর্স ও বৃত্তিসংক্রান্ত তথ্য, আবাসিক সুবিধা, জীবনযাত্রার মান বা খরচ, খাবার, ভৌগোলিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার তথ্য সংরক্ষণ ও হালনাগাদ করতে হবে।

একসময় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য অল্প পরিমাণে হলেও বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে সার্ক বৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে পড়ার ব্যবস্থা থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। তাই বিদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য সংরক্ষিত আসনসহ বৃত্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া অনুরোধ ও প্রস্তাব নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বৃত্তি প্রদানকারী সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হতে হবে, যাতে তাদের প্রদত্ত বৃত্তি দিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। এর জন্য প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দপ্তর ও অধিদপ্তরের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং উন্নত কর্মপরিকল্পনা। চীন সরকার বিদেশি শিক্ষার্থীদের ১০ শতাংশ বৃত্তি প্রদান করে থাকে এবং বাকি ৯০ শতাংশ নিজস্ব খরচে পড়াশোনা করে থাকে। ভারত সরকার বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন বৃত্তির ব্যবস্থা রেখেছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করার জন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে দেশে একটি কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। প্ল্যাটফর্মটি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে সমন্বয়ের মাধ্যমে সহযোগিতা করবে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে পছন্দের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ভর্তির আবেদন করতে পারবে এবং ভর্তির ফলাফল জানতে পারবে।

এ দেশে বিদেশিদের শিক্ষা ও জীবনযাত্রা সহজ করতে বাংলা ভাষা শিখতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এসব বিদেশি শিক্ষার্থীর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। অ্যালামনাই করে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগসূত্র ধরে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব ও প্রচারক হিসেবে এসব বিদেশি গ্র্যাজুয়েট জীবনকাল কাজ করবে।

মো. সহিদুজ্জামান: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
[email protected]