তেলের দাম নিয়ে কিছু বলা যায় না

জিম ও’নিল
জিম ও’নিল

তেলের দাম নিয়ে লিখতে যাওয়া সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে আমি বলেছিলাম, তেলের দাম ক্রমেই কমছে। এমনকি এই ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলাম যে তেলের ‘দাম বছরের শুরুর তুলনায় শেষে বেশি’ থাকবে। আমি তখন ভুল করেছিলাম। আমি তখন ভুল করেছিলাম, কিন্তু আমি হয়তো বেশি দিন আর ভুল করব না।

সম্প্রতি আমি আবুধাবি পেট্রোলিয়াম এক্সিবিশন অ্যান্ড কনফারেন্সে (এডিআইপিইসি) আলোচনা করেছি। এই সম্মেলনটা তেলের বাজারের অংশীদারদের জন্য দাভোসের মতো। সেখানে যখন ছিলাম, তখন তেলবিষয়ক নির্বাহীদের আলোচনার শেষ পর্যায়ে আমি যোগ দিই। সেখানে তাঁরা সবাই এই ব্যাপারে একমত হন যে আগামী বছর এই সময় অপরিশোধিত তেলের দাম আজকের মতো ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারই থাকবে।

সিএনবিসির প্রতিবেদক স্টিভ সেজউইকের আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ছিল। তাঁকে আমি বললাম, ‘এটাই প্রথম, এক বছরের মধ্যে তেলের দামের তেমন পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, সাক্ষাৎকারের শুরুতে সেজউইক দর্শকদের আমার বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত করেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি কেন অন্যদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি।

নিজের ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে আমি কিছু সাধারণ সতর্কবার্তা দিতে চাই। তেলের দাম নিয়ে আগাম বার্তা দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হলেও বস্তুত এ কারণে মুদ্রাবাজার নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা সহজ হয়ে যায়।

১৯৭০-এর শেষভাগে ও ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে তেলের বাজারের ওপর আমি যখন পিএইচডি করি, তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে তেলের দাম নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা সময় ও শক্তির অপচয়। পরবর্তীকালে আমি যখন গোল্ডম্যান স্যাকসে কাজ শুরু করি, তখন আমি প্রায়ই গবেষকদের মধ্যে পণ্য বিশ্লেষকদের তেলের দামের বিশৃঙ্খলা নিয়ে হিমশিম খেতে দেখেছি।

সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় সেজউইক বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রসঙ্গ তুলেছেন। সেটা হলো অন্যান্য সম্পদের দামের উত্থান-পতনের প্রবণতা গত কয়েক বছরে বেশ কমলেও তেলসহ অন্যান্য সম্পদের দাম স্থিতিশীল হতে হয়তো আরও সময় লাগবে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এটা হবে। নীতিগতভাবে তিনি সঠিক।

কিন্তু আমি বলব যে মুদ্রা, বন্ড ও ইকুইটি বাজারের অস্থিরতা দূর হওয়ায় বোঝা যায়, বিশ্বের অনেক জায়গায় মুদ্রাস্ফীতির হার কম। আরও
বোঝা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রা নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় আনতে পারেনি। আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে এই ব্যাপারগুলো তেলের বাজারের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য কি না, বিশেষ করে জ্বালানি বাজারে যখন সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

চাহিদার দিক থেকে বোঝা যায়, বাজার বিশ্লেষকেরা শেষমেশ একটি ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠছেন, যেটা ২০১৭ সালের বেশির ভাগ সময়জুড়ে দৃশ্যমান ছিল। সেটা হলো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গতি এসেছে, এখন তার প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ বা তারও বেশি। ভারত ও যুক্তরাজ্য ছাড়া ১০টি বড় অর্থনীতির মধ্যে ৮টি অর্থনীতি একই সময়ে বড় হচ্ছে। অনেক দেশ যেখানে তেল ছাড়তে চাইছে, সেখানে এই পরিবর্তন দ্রুত ঘটবে না। আর তেলের বাজারও যথাযথভাবে শক্তিশালী দাবির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে।

সরবরাহের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী সৌদি আরবের কারণে সম্প্রতি অনেকে সতর্ক হয়ে গেছে। সৌদি সরকার এখন পররাষ্ট্রনীতিতে ও দেশের ভেতরে অনেক বিপ্লবী পরিবর্তন আনছে। তবে এর কারণ পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। আর এতেও বিস্ময়ের কিছু নেই যে বাজারের অংশীদারেরা হঠাৎ করে তেলের দামে প্রিমিয়াম যুক্ত করতে চাইছে।

অনেক দিন ধরেই আমি পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য তেলের ভারসাম্যপূর্ণ দামের ভবিষ্যদ্বাণী করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে আমি ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম ব্রেন্ট ক্রুড স্পট অয়েল প্রাইস ব্যবস্থা সন্দেহের কারণে বাড়ে-কমে না, সে কারণে এটি অনেকটা বিশুদ্ধ বাণিজ্যিক চাহিদা সরবরাহের ব্যাপার।

সম্প্রতি তেলের দাম কিছুটা বাড়ার আগে আমি দামের তালিকা করেছিলাম, সেখানে দেখা যায়, কিছুদিন স্থিতিশীল থাকার পর আগামী পাঁচ বছরে তেলের দাম বাড়বে। স্পট মূল্য পাঁচ বছর পরের মূল্যের ওপরে উঠে যাওয়ায় কেউ বলতে পারেন, ধারার পরিবর্তন হলো বলে। আমার প্রসঙ্গে বলতে পারি যে আমি অনিশ্চিত, কিন্তু এটা হলে আমি বিস্মিত হব না।

এবার সেজউইকের প্রশ্নে ফিরে আসি। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলার হতে পারে। তবে আমার অনুমান হলো সেই সময়ে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারে উঠে যেতে পারে। সেজউইক আবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তেল কোম্পানিগুলো কীভাবে এই চক্র থেকে নিজেদের রক্ষা করে বিনিয়োগ ও পরিচালন সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারে। প্রশ্ন হলো দাম বাড়ার সময় তেল কোম্পানিগুলোর পক্ষে কি উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং দীর্ঘকাল দাম কম থাকার সময় অস্থিরতা পরিহার করা সম্ভব?

প্রশ্নটা কঠিন। আমার উত্তর হলো তেল কোম্পানিগুলোকে পণ্য-বিশ্লেষণ করতে হবে, যেটা আমি শুরু করলেও শেষ করতে পারিনি। তাদের বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়া বের করতে হবে, যার মাধ্যমে তেলের ভারসাম্যপূর্ণ অন্তর্নিহিত মূল্য বের করা যায়। আর তেলের দাম যখন ওই দুটি স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন অতিক্রম করে যায়, তখন তাদের সহকর্মী, বিশ্লেষক ও শিল্পের অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষকদের মত অগ্রাহ্য করতে হবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

জিম ও’নিল: গোল্ডম্যান স্যাকস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান।