গণতন্ত্র নাকি উন্নয়ন? কেন নয় দুই-ই

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

আনিসুজ্জামান স্যারের একটা কথা তাড়িয়ে ফিরছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘আমি তাকে পারি না এড়াতে।’ ৮ নভেম্বর সংবিধান দিবসের আলোচনায় তিনি বলেন, ‘আজ মনে হয়, ১৯৭১ থেকে আমরা দূরে, বহু দূরে চলে এসেছি এবং ১৯৭১-এর পূর্ববর্তী ২৪ বছরের সংগ্রাম ও অর্জনের ধারার সঙ্গে তুলনা করলে তার পরবর্তী ৪৬ বছরের ধারাকে পশ্চাদপসরণ ও বিসর্জনের ইতিহাস বলতে হবে।’

আনিসুজ্জামান স্যারের কথা দুর্ভাবনা বাড়ায়। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্যহীনতা, মানবাধিকার—এসব ক্ষেত্রে আমরা আসলেই এগোলাম, নাকি পেছালাম?

মনে সান্ত্বনা আনার চেষ্টা করি। সৈয়দ শামসুল হকের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম একবার। সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, মানুষের ইতিহাসকে দুই-চার বছরের মাপকাঠি দিয়ে মেপো না। হাজার বছরের ইতিহাসে দুই-চার-দশ বছরে মনে হতে পারে আমরা পেছাচ্ছি, কিন্তু সার্বিকভাবে মানুষের ইতিহাস হলো এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস।
কিন্তু সান্ত্বনা তো পাই না। পাল্টা মনে পড়ে নাজিম হিকমতের কবিতা:

জেলে এলাম সেই কবে
তার পর গুনে গুনে দশ-বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী।
পৃথিবীকে যদি বলো, বলবে—
‘কিছুই নয়,
অণুমাত্র কাল।’
আমি বলব—
‘না, আমার জীবনের দশটা বছর।’
যে বছর জেলে এলাম
একটা পেন্সিল ছিল
লিখে লিখে ক্ষইয়ে ফেলতে এক হপ্তাও লাগেনি।
পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে বলবে:
‘একটা গোটা জীবন।’
আমি বলব:
‘এমন আর কী, মোটে তো একটি সপ্তাহ।’
৪৬ বছর মহাকালের বিচারে হয়তো
একটা বুদ্‌বুদমাত্র, কিন্তু আমাদের তো সমস্তটা জীবন।

আরেকটা সেমিনারে উচ্চারিত কিছু কথা থেকে উদ্ধৃতি দিই।
১৮ নভেম্বর সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ আয়োজিত এক সেমিনারে অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেছেন, ‘গত কয়েক বছরে, বিশেষত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মধ্যে একটি বিভাজন রেখা টানা হচ্ছে এবং এদের পরস্পরের বিকল্প বা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই উল্লেখ করা হচ্ছে। এই ধারণার আলোকে ক্ষমতাসীন দল ও তার সমর্থকদের বক্তব্য হচ্ছে যে প্রচলিত গণতন্ত্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করে, যা উন্নয়নের পথে বাধাস্বরূপ। ফলে ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’-এর পথই দেশের জন্য ইতিবাচক।’ (কালের কণ্ঠ, ১৯ নভেম্বর ২০১৭) এই সেমিনারেই আকবর আলি খান বলেছেন, ‘বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রের আনুকূল্যে। ফলে এখানে অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে।’ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বিষয়ে তিনি বলেন, ধর্ম নিয়ে হইচই শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশেই আছে। এটি দূর করা সম্ভব নয়। আবার ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ পুরোনো পথেই আছে। ফলে এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবিলা করতে হবে। (প্রথম আলো, ১৯ নভেম্বর ২০১৭)
আলী রিয়াজ যে প্রসঙ্গটা এনেছেন, উন্নয়ন নাকি গণতন্ত্র, এ ধরনের একটা কথা আজকাল শোনা যায় বটে। পাশাপাশি আরেকটা বাছাই আমাদের করতে বলা হয়, জঙ্গিবাদমুক্তি বনাম গণতন্ত্র, যেকোনো একটা বেছে নিতে হলে কী করবে?

আশার কথা হলো এই সেমিনারেই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, গণতন্ত্র নয়, উন্নয়ন আগে—এটা আওয়ামী লীগের বক্তব্য নয়।
আকবর আলি খান যা বলেছেন, তা-ও আমলে নেওয়ার মতো। এক পদ্মাবতী ছবি নিয়ে মোদির দেশ ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা যা করছে, তাতে
উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় থাকে না। অরুন্ধতী রায় তাঁর মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস উপন্যাসে একটা কাহিনি লিখেছেন: একজন দলিত, চর্মকার খবর পান যে একখানে একটা গরু মরে পড়ে আছে। তিনি একটা টেম্পোতে তুলে সেই গরু নিয়ে ফিরছিলেন। গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তাকে থানায় নেওয়া হয়। উত্তেজিত জনতা থানা ঘেরাও করে, সেই চর্মকারকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। আমরা সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করতে পারি এ কথা ভেবে যে এটা নিছকই বানানো গল্প, সত্য নয়। কিন্তু সংবাদপত্রের পাতায় যেসব খবর প্রকাশিত হয়, তা এর চেয়ে কম ভয়াবহ নয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর তাঁর উপলব্ধি কী হয়েছিল, তা লিখে রেখেছেন। ‘এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ করা গেছে, জনগণকে ‘ইসলাম ও মুসলমানের নামে’ ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না এ ধারণা অনেকেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।’ বঙ্গবন্ধুর ওই উপলব্ধি থেকে আমাদের উপলব্ধি আলাদা হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। তখনকার সমাজ থেকে আজকের সমাজ পিছিয়ে গেছে, এমন ভাবনার কারণ নিশ্চয়ই ঘটে, তবে তা থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া
সংগত হবে না। ভারতে মোদি, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প, ব্রিটেনে ব্রেক্সিট—সব মিলিয়ে হতাশ হওয়ার মতোই তো পরিস্থিতি।

এই অবস্থায় বাংলাদেশে আমাদের পথ আর পাথেয় হওয়া উচিত আরও বেশি গণতন্ত্র। মানবাধিকার। আইনের শাসন। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। অসাম্প্রদায়িকতা। এটা যেমন সরকারের দিক থেকে, তেমনি জনগণের দিক থেকে, সামাজিক শক্তিগুলোর দিক থেকে, পেশাজীবীদের দিক থেকে।

মনে হতে পারে, জঙ্গিবাদ নির্মূলে, রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গণতন্ত্রের প্রশ্নে কিংবা মানবাধিকারের প্রশ্নে কিংবা বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে খানিকটা ছাড় বোধ হয় দেওয়া যেতেই পারে। একই কথা বলা হয়ে থাকে উন্নয়নের প্রশ্নেও। যে উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি বুলি বিসর্জন দেওয়া যেতেই পারে। অমর্ত্য সেন এ বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন। তিনি তাঁর উন্নয়ন ও স্ব-ক্ষমতা বইয়ে ‘গণতন্ত্রের গুরুত্ব’ নামের প্রবন্ধটা শুরু করেছেন সুন্দরবনের মৌয়ালদের কথা দিয়ে। সুন্দরবনে যাঁরা মধু সংগ্রহ করতে যান, এক বোতল মধু বিক্রি করে তাঁরা পান ৫০ সেন্ট, কিন্তু প্রতিবছর প্রায় ৫০ জন মৌয়াল বাঘের কামড়ে মারা যান।

এখন প্রশ্ন হলো মৌয়ালদের জীবন আগে, নাকি জীবিকা আগে? যেসব মানুষ জীবিকার নিশ্চয়তার জন্য নিজেদের জীবন প্রতিবছরই দান করে যাচ্ছে, জীবিকার নিশ্চয়তার জন্য তারা কি গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নয়? অমর্ত্য সেনই জানাচ্ছেন, সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ এই মতবাদ প্রবর্তন করেছেন যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়নের পক্ষে ক্ষতিকর। অমর্ত্য সেন তাঁর এই প্রবন্ধে এবং আরও অনেক প্রবন্ধে বারবার করে বলছেন, গণতন্ত্র মোটেও উন্নয়নের জন্য বাধা নয়, বরং গণতন্ত্র থাকলেই উন্নয়ন টেকসই হয়।

আমাদের কেন গণতন্ত্র আর উন্নয়নের মধ্য থেকে কেবল একটিকে বেছে নিতে বলা হবে? কেন গণতন্ত্র ও জঙ্গিবাদমুক্তি থেকে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে? এ যেন একজন শিশুকে বলা যে তোমার বাবা আর মায়ের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে বেছে নাও। যেকোনো বুদ্ধিমান শিশুর মতো আমরাও বলব, আমরা দুটোই চাই।
শুনতে ভালো লাগে যে আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, গণতন্ত্র নয়, উন্নয়ন—এ কথা আওয়ামী লীগ বলেনি। এবং এটা শুনে আরও ভালো লাগল যে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যে দেশে স্বৈরশাসন চলে; গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, জবাবদিহির অভাব থাকে; সে দেশে দুর্নীতির শিকড় গেড়ে যায়। সেই শিকড় উপড়ে ফেলা কঠিন হয়ে যায়। বর্তমান সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে স্বৈরশাসন, সেনাশাসন, অবিচার, অত্যাচার; যার কারণে এখনো দুর্নামের ভাগীদার হতে হচ্ছে।’

শেখ হাসিনা যা বলেছেন, অমর্ত্য সেন প্রায় সেই কথাই পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠাজুড়ে লিখে রেখেছেন। গণতন্ত্র না থাকলে দুর্নীতি আসে, জবাবদিহি না থাকলে দুর্নীতি আসে, উন্নয়ন ব্যাহত হয়। জনগণের চাওয়া-পাওয়া অভাব-অভিযোগ প্রকাশ করতে দিতে হবে নির্ভয়ে, বাধাহীনভাবে। এটা কেবল মানুষের মৌলিক অধিকার বলেই নয়, এটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়, উন্নয়ন নিশ্চিত করে বলেও। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র হয় না। আর পিনোশের আমলের চিলির উদাহরণ দিয়ে অমর্ত্য সেন বলেছেন, বিরোধী দল থাকলে তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য হলেও এমনকি কর্তৃত্ববাদী সরকারকেও জনকল্যাণমূলক কাজ করতে হয়। তাঁর ভাষায়, ‘এসব দেশে সমাজসেবার যেসব কাজ কিছু সাফল্যের সঙ্গে চালু হয়েছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিরোধীদের আক্রমণ হ্রাস করা এবং এরূপে ক্ষমতায় আসার পূর্বেই বিরোধীরা কিছুমাত্রায় কার্যকর হয়েছিল।’
গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়।

নিশ্চয়ই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট বুশ একবার কম ভোট পেয়েও আদালতের রায়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন, এবারও পপুলার ভোট ট্রাম্পের চেয়ে বেশি পেয়েছেন হিলারি।

আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক, এটা তো আরও এক বছরের পরের ব্যাপার। এই মুহূর্তে দরকার ভয়ের পরিবেশ দূর করা। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে একটা কর্মস্পৃহা, নিজেদের উন্নতি ঘটানোর মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ঘটানোর কর্মচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে, তার একটা বড় কারণ গণতন্ত্র। বলার স্বাধীনতা, চলার স্বাধীনতা, নিরাপত্তার বোধ। এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার হওয়া উচিত তা নিশ্চিত করা। গত নির্বাচনে বড় দল অংশ নেয়নি বলেই এই মেয়াদে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোর চর্চা হওয়া উচিত আরও বেশি। পৃথিবীকে বাঁচানোর আবেদন জানিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য ছবি হোম-এ বারবার বলা হয়, ইটস টু লেট টু বি আ পেসিমিস্ট। এত দেরি হয়ে গেছে যে আর হতাশ হওয়ার উপায় নেই।
হতাশ না হয়ে আসুন ইতিবাচক কিছু করি।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।