বিশ্বসভায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বমানবতা যখন চরম অবক্ষয়ের তিমিরে নিমজ্জিত, জুলুমের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত; সভ্যতা যখন বিপন্ন, মানবাধিকার যখন ভূলুণ্ঠিত; নিখিলের ভাগ্যাকাশে কালবৈশাখী দুর্যোগের ঘনঘটা। তখন জগৎপতি মহান স্রষ্টা দয়াময় আল্লাহ উত্তরণের তরণিরূপে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ তথা সমগ্র বিশ্বের রহমত, খোদার হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে রবিউল আউয়াল মাসের শুক্লপক্ষে স্নিগ্ধ শশী জ্যোতি বিকিরণের নিমিত্তে ধরাধামে পাঠালেন।

আবির্ভাব
আজ থেকে প্রায় ১৪৪৪ সৌরবছর আগে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল, আরবি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জগতের গুরু হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই ধরায় শুভাগমন করেন। মানববাগানে প্রস্ফুটিত হলো জগতের সর্বসেরা ফুল। পুণ্যময় পূর্ণিমা শশীর পূর্ণ আলোক আভা নিয়ে জগৎকে আলোকিত করতে তিনি এলেন। তাঁর জন্মবার ছিল সোমবার। রহমত ও বরকতে পরিপূর্ণ দিন সোমবার, সপ্তাহের মধ্য দিবস বলে খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত। নবী করিম (সা.) সোমবার রোজা পালন করতেন। সাহাবিরা জানতে চাইলেন, ‘হুজুর! আপনি কেন প্রতি সোমবার রোজা পালন করেন?’ নবীজি (সা.) উত্তরে বললেন, ‘সোমবারেই আমার জন্ম হয়েছিল; তাই এই দিনে আমি রোজা পালন করে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করি।’ (মুসলিম শরিফ)। তাই মদিনাবাসী সপ্তাহে সোমবার রোজা পালন করে থাকেন। প্রতি সোমবার মদিনা শরিফে মসজিদে নববিতে ইফতারের বিশেষ আয়োজন করা হয়ে থাকে।

প্রাতঃকালে এলেন তিনি। বর্বর যুগের পশুসুলভ জীবনাচার ও জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতনের সামাজিক অন্যায়-অবিচার ও অত্যাচারের তমসা হতে মানবতাকে সভ্যতার আলোর দিকে এগিয়ে নিতে; তিনি ভোরের সমীরণ প্রবাহ সঙ্গে নিয়ে, প্রভাত রবির রঙিন আলোয়, সকালের সূর্যের হাসি হয়ে উষার আকাশে উদিত হলেন মুক্তির দূতরূপে। তখন চলছিল আইয়ামে জাহেলিয়াত, মানে অন্ধকার যুগ। অজ্ঞানতা, মূর্খতা, কুসংস্কার ও দুর্নীতি, পাপাচারে লিপ্ত ছিল জাজিরাতুল আরব বা আরব উপদ্বীপবাসী। এ সময় জ্ঞানের আলো নিয়ে, মুক্তির বাণী নিয়ে স্বর্গ হতে মর্ত্যে নেমে এলেন মানবতার মহান বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আলোক জ্যোতি ও মহাগ্রন্থ এসেছে।’ (সুরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ১৫)। সে মহাগ্রন্থ আল–কোরআন এবং আল–কোরআনের বাস্তব রূপ হলেন আল্লাহর হাবিব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)।

কোরআনে তাঁর নাম ‘মুহাম্মদ’
মুহাম্মদ অর্থ সর্বাধিক প্রশংসিত। চিরপ্রশংসিত ‘মুহাম্মদ’ তাঁর নাম। এ নামটি জন্মের আগেই মা ‘আমিনা’কে স্বপ্নযোগে জানিয়েছেন মহান আল্লাহ তাআলা। এই মুহাম্মদ নামটি কোরআন করিমে রয়েছে চারবার। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) একজন রাসুল; তাঁর পূর্বে বহু রাসুল গত হয়েছেন। সুতরাং, যদি তিনি ইন্তেকাল করেন অথবা শাহাদতবরণ করেন, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না; বরং আল্লাহ শিগগিরই কৃতজ্ঞদিগকে পুরস্কৃত করবেন।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৪৪)। ‘মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং সর্বশেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা-৩৩ আহযাব, আয়াত: ৪০)। ‘যারা ইমান আনে, সৎকর্ম করে এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস করে, আর উহাই তাদের প্রতিপালক হতে প্রেরিত সত্য, তিনি তাদের মন্দ কর্মগুলো বিদূরিত করবেন এবং তাদের অবস্থা ভালো করবেন।’ (সুরা-৪৭ মুহাম্মাদ, আয়াত: ২)।

ইঞ্জিল কিতাবে তাঁর নাম ‘আহমাদ’
আহমাদ অর্থ সর্বাধিক প্রশংসাকারী। আহমাদ নামটি কোরআনে আছে একবার। ‘আর যখন ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.) বললেন, হে বনি ইসরাইল! নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর রাসুল তোমাদের প্রতি প্রেরিত; সত্যায়নকারী তোমাদের মাঝে তাওরাতের যেটুকু রয়েছে তার। এবং সুসংবাদদাতা এক রাসুলের, যিনি আমার পরে আগমন করবেন; তাঁর নাম “আহমাদ”।’ (সুরা-৬১ সফ, আয়াত: ৬)।

তাওরাত কিতাবেও রয়েছে তাঁর নাম
আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন, ‘মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল; তাঁর সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাহাদিগকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবেন। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার প্রভাব পরিস্ফুট থাকবে: তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপ এবং ইঞ্জিলেও তাদের বর্ণনা এরূপই। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যা হতে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর ইহা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের ওপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, যা চাষির জন্য আনন্দদায়ক।’ (সুরা-৪৮ ফাতহ, আয়াত: ২৯)।

তিনি ‘রউফ’ ও ‘রহিম’ প্রিয় নবী
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই মহামানবের বহু নাম ও উপনাম রয়েছে। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার রয়েছে অসংখ্য অগণিত পবিত্র নাম। এরই মধ্যে নিরানব্বই বা শত নাম প্রসিদ্ধ। প্রিয় নবীজিরও শত নাম পরিচিত ও সুবিদিত। সেই মহামানবের আগমনবার্তা কোরআন করিমে ঘোষণা হয়েছে এভাবে, ‘অবশ্যই তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের নিকট এক রাসুল এসেছেন। তোমাদিগকে যা বিপন্ন করে তা তার জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মোমিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। অতঃপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আপনি বলুন, “আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই। আমি তাঁরই ওপর নির্ভর করি এবং তিনি মহা আরশের অধিপতি।”’ (সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ১২৮-১২৯)।

তিনি কামলিওয়ালা
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নানান অভিধায় অভিহিত করেছেন, বিভিন্ন বিশেষণে বিভূষিত করেছেন, বিবিধ সম্ভাষণে সম্বোধন করেছেন। আহ্বান করেছেন কখনো ‘তহা’, আবার কখনো ‘ইয়াসিন’। (সুরা-২০ তহা, আয়াত: ১; সুরা-৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ১)। এসবের মাঝে পরিচিত তিনি ‘কামলিওয়ালা’ নবী তথা ‘মুয্যাম্মিল’ ও ‘মুদ্দাচ্ছির’ নামে। (সুরা-৭৩ মুয্যাম্মিল, আয়াত: ১ ও সুরা-৭৪ মুদ্দাচ্ছির, আয়াত: ১)।

তিনি ‘মুআল্লিম’ বিশ্বশিক্ষক
তাঁর শতসহস্র গুণবাচক নামের আরেকটি হলো মুআল্লিম অর্থাৎ শিক্ষক। সত্যিই তিনি ছিলেন বিশ্বশিক্ষক। তিনি শিখিয়েছেন প্রেম–ভালোবাসা, শিখিয়েছেন ভ্রাতৃত্ব ও সাম্য, শিখিয়েছেন মানুষের প্রতি মানুষের অধিকার ও কর্তব্য। সর্বোপরি আরও শিখিয়েছেন স্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টের সেবা।

তাঁর নাম সবার ঊর্ধ্বে
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রিয় নবী রাহমাতুল্লিল আলামিনের সুমহান নাম ও আলোচনা সমুন্নত করে দিয়েছেন। তিনি বলেন: ‘আর আমি আপনার স্মরণ ও আলোচনা উন্নত করেছি।’ (সুরা-৯৪ ইনশিরাহ, আয়াত: ৪)।

বর্তমান মদিনা শরিফের হারাম শরিফে মসজিদে নববির পশ্চিম পাশে পাশাপাশি রয়েছে মহান আল্লাহ তাআলার নামসমূহের ও মহানবী (সা.)-এর নামসমূহের দুটি জাদুঘর; যাতে নামের পরিচয় ও গুণের বিবিধ বিবরণ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রদান করা হয়ে থাকে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।[email protected]