সবকিছু ভেঙে পড়ে

আমাদের পরিচিত একটি মেয়ে এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা দিচ্ছে। আর্থিক অনটনে বড় হওয়া মেয়েটি খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করে। মাস্টারের টাকা জোগাড় করতে দরজি বাবা আর ছুটা বুয়া (গৃহকর্মী) মা ডাবল ডাবল কাজ করেন। তাঁদের স্বপ্নটা খুব ছোট্ট। মেয়েটা একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে। অফিসে চাকরি করবে। ছুটা বুয়া হবে না।

মধ্য আয়ের ঢাকঢোল বাজানো এই দেশে এই চিত্রই সর্বজনীন। একদিকে মেয়েদের শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে, বিনা মূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার গালভরা স্লোগান আছে, আরেক দিকে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার ফি, ভর্তির ফি, কোচিংয়ের টাকা, গৃহশিক্ষকের বেতন—এসব জোগাড় করতে বেশির ভাগ মা-বাবাই ধারদেনা করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।

কিন্তু এরপরও স্বস্তি নেই। প্রায় প্রতিটি বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এসব কেলেঙ্কারির সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হলো প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার বিদঘুটে এক ভুলে ভরা প্রশ্নপত্র। ব্যাকরণের ভুল বা প্রশ্নের হযবরল গঠন ছাড়াও ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’-বিষয়ক এই প্রশ্নপত্রের অনেক প্রশ্নই অদ্ভুত, বিশৃঙ্খল এবং মানহীন। প্রায় প্রতিটি প্রশ্নেই শিক্ষার্থীদের সাধারণ যুক্তিবোধ বা সাধারণ বিবেচনাবোধের সঙ্গে অদ্ভুত প্রহসন করা হয়েছে!

জানা গেল, বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করে ন্যাশনাল একাডেমি ফর প্রাইমারি এডুকেশন (এনএপিই)। বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রথমে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রশ্নপত্র পেশ করলে এনএপিইর পরিচালকের অনুমোদন সাপেক্ষে সেটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে (ডিপিই) হস্তান্তর করা হয়। ডিপিইর মহাপরিচালকের স্বাক্ষর ছাড়া প্রশ্নপত্র বিতরণের সুযোগ নেই। অর্থাৎ দীর্ঘদিনের সক্রিয় একটি কাঠামো এখানে রয়েছে। ধাপে ধাপে ভুল শুধরানোর সুযোগ বা ব্যবস্থাও এখানে আছে। অথচ বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন বলছে, প্রশ্নপত্রের ভুল বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি অবাক হয়ে বলেছেন, ‘আমি বিষয়টা জানি না।’ ঘটনা বোঝাই যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত এবং সাধারণভাবে ‘কার্যকর’ নিয়মগুলোও এখন আর কাজ করছে না।

ঘটনা এখানেই থেমে নেই। পত্রিকা মারফত জানা গেল, প্রশ্ন-ভুলের ঘটনায় একজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ভাবলাম, কোনো হোমরাচোমরার চাকরি গেল মনে হয়। পরে দেখা গেল, বরখাস্তকৃত ব্যক্তিটি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার একজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা! নাম আবদুল মান্নান। এদিকে বিডিনিউজ২৪-এর বরাতে জানা গেল, সাদুল্যাপুরে ওই নামে কোনো শিক্ষা কর্মকর্তাই নেই। বাহ্! বেশ একটা সার্কাস সার্কাস ব্যাপার আরকি।

তা শিক্ষাকে সার্কাস বানাল করা? বাংলাদেশের শিক্ষার মান কোনো আমলেই খুব সন্তোষজনক কিছু ছিল না। মুখস্থ বিদ্যার বিভীষিকা কাটাতে প্রায় এক দশকের গবেষণা, পর্যালোচনা আর দেনদরবারের পর এসেছিল সৃজনশীল পদ্ধতি। ঠিকমতো বাস্তবায়িত হলে সৃজনশীল পদ্ধতির সম্ভাবনা অসীম। কিন্তু বাস্তবায়নটা করবে কে? গণহারে প্রশ্নফাঁস, ওপরের নির্দেশে পাইকারি হারে পাস করিয়ে দেওয়া আর সর্বস্তরে দলীয় নিয়োগ—এসবের রাজত্বে ভালো কাজ করার লোকগুলো সব কোথায়?

শিক্ষা খাতে বাজেট অপ্রতুল—এমন বলারও উপায় নেই। মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছর জেলাপ্রতি, এমনকি স্কুলপ্রতিও বিপুল বরাদ্দ থাকে। সেই বরাদ্দ নিয়ে কী তুঘলকি কাণ্ড হয়, সেটা ২০১৩ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন দেখলেই বোঝা যায়। স্কুল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে টাকা লুটপাটের অভিযোগ বিস্তর। মেয়েদের বৃত্তির টাকা না দেওয়া, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, ভুয়া শিক্ষক সাজিয়ে বছরের পর বছর বেতন নেওয়া—এসব তো এখন প্রতিটি স্তরেই স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবার প্রচুর অর্থ খরচ করে শিক্ষার মানোন্নয়নে যেসব গবেষণা করা হয়, সেগুলোও বছরের পর বছর ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করছেন—এমন এক বন্ধু জানালেন, ‘শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করতে বসলে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করে। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে বেশির ভাগেরই শিক্ষা বিষয়ে কোনো আগ্রহ তো নেইই, ন্যূনতম যোগ্যতাও নেই। প্রচুর খাটাখাটনি করে গ্রামপর্যায়ের সমস্যাগুলো নিয়ে প্রতিবেদন জমা দিলে মুখের ওপর তা বাতিল করে দেওয়া হয়। বলা হয়, সব তো ঠিকই চলছে, আপনারা আমাদের চেয়ে বেশি বোঝেন?’

জানা গেল, প্রতিটি জেলা-উপজেলা পর্যায়েই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কার্যালয় আছে। অসংখ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা আছেন। গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত শিক্ষকের নিয়োগ, পর্যাপ্ত স্কুল ভবন নির্মাণ, শিক্ষকদের মনিটরিং, ট্রেনিং—এসব কাজের দেখভাল করতে জনগণের করের টাকায় বেতন পাচ্ছেন তাঁরা। অথচ এই শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিশাল একটা অংশ কোনো কাজ করে না। আর যিনি ঠিকমতো কাজ করতে চান, স্কুলপর্যায়ে প্রভাবশালীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, সবাই মিলে তাঁর বারোটা বাজায়। শিক্ষা প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে অযোগ্য লোক নিয়োগের এই মচ্ছবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনোই দায় নেই?

এই দেশের অসংখ্য অগণিত খেটে খাওয়া মানুষ ঘাম ঝরিয়ে, জান পানি করে, তার সন্তানকে স্কুলে পাঠায়। বছর শেষে ধারদেনা করে, হাত পেতে, এক বেলা বেশি খেটে, দুই বেলা কম খেয়ে সন্তানের পরীক্ষার ফি জোগাড় করে। তারা লুটপাটের স্বপ্ন দেখে না। সেকেন্ড হোমের স্বপ্ন দেখে না। স্বপ্ন খুব সামান্যই। সন্তান শিক্ষিত হবে। চাকরি করবে। লাখো অভিভাবকের জান বাজি রাখা আছে এই শিক্ষা খাতে। সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা হতভাগা এই বাংলাদেশের শেষ ভরসাও এই শিক্ষা খাত। অথচ তিলে তিলে আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই কফিনের শেষ পেরেকগুলো মারা হচ্ছে।

এসব অনিয়মের মধ্যেই স্কুল-কলেজ শেষ করে লাখো ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে বের হচ্ছে। খুব অল্পদিনের মধ্যেই বোঝা যাবে এর ভয়ানক পরিণাম।

লেখক, গবেষক, অ্যাকটিভিস্ট