সিইসি, ইসি ও প্রসঙ্গ-কথা

মহিউদ্দিন আহমদ একজন বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক। প্রথমা থেকে প্রকাশিত তঁার চারটি বই—জাসদের উত্থান–পতন, বিএনপির সময়-অসময়, আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০, আওয়ামী লীগ: যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১ আগ্রহ ও মনোযোগসহকারে পড়েছি। একজন প্রকৃত গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন। কিন্তু ‘আমরা কবে সাবালক হব?’ শিরোনামে যে লেখাটি তিনি লিখেছেন, সেখানে সাবালকত্বের পরিচয় মোটেও মিলে না।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে বলে আমার একটি বক্তব্য নিয়ে। একই সঙ্গে আমি উল্লেখ করেছিলাম, সেনাবাহিনী মোতায়েন সম্পর্কে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। পরবর্তী সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা এ বিষয়ে যা কিছু বলেছেন, তাতে তঁার সঙ্গে আমার বক্তব্যে তেমন কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সুধী সমাজের কেউ কেউ যাচিত ও অযাচিতভাবে পরামর্শ দিয়েছেন—নির্বাচন কমিশনে আমরা সবাই যেন পরস্পর সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা সমীচীন নয় ইত্যাদি। মিডিয়ার কারও কারও একটি প্রবণতা হলো, কমিশনারদের কোনো কোনো বক্তব্য ভিন্নভাবে তুলে ধরা, যাতে প্রতীয়মান হয় যে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতের মিল নেই।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের মতের মিল থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমাদের মন ও মনন এক ও অভিন্ন মেশিনে তৈরি নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা এবং নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী—প্রত্যেকেই আপন স্বাতন্ত্র্যে ও ব্যক্তিত্বে সমুজ্জ্বল। কমিশনের সভায় সবাই স্বাধীনভাবে অভিমত ব্যক্ত করেন। বিভিন্ন মতামত উপস্থাপনার পর নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমঝোতার কোনো অসুবিধা হয়নি। যদি কোনো বিষয়ে কারও ভিন্ন মত থাকে, তাহলে তিনি দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে পঁাচজন নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবকাশ থাকে। তবে এ পর্যন্ত কমিশনের কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দ্বিমত প্রকাশের ঘটনা ঘটেনি। সর্বক্ষেত্রে পঁাচজনের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে সমঝোতার মাধ্যমেই সব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

আবার মহিউদ্দিন আহমদের কথায় আসি। আমি আমার স্মৃতিকথা আমলার আমলনামায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা সম্পর্কে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছি। বইটি লেখা হয় ১৫ বছর আগে এবং প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও আমি ১৮ বছর আগে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার স্মৃতিকথায় তঁার বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য বা মন্তব্য আছে। ঘটনাটি এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না, যার জের টেনে ১৮ বছর পর বলতে হবে ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, তঁাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন আছে। কোনো পুরোনো ÿক্ষত থেকে পুঁজ বেরোচ্ছে।’ এই উক্তি আপত্তিকর, আমি এর প্রতিবাদ জানাই।

মহিউদ্দিন বলেছেন, কে এম নুরুল হুদা একজন সৎ ও সজ্জন মানুষ। আমি তঁার এ কথার প্রতিধ্বনি করি। নুরুল হুদা একজন সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা। ভারতে গেরিলাযুদ্ধের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং অসমসাহসের পরিচয় দেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি তঁাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। আমি তো তঁার মতো অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা হতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধকালে আমি মুজিবনগর সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করি। আমার সহকর্মী ছিলেন এম আর আখতার মুকুল ও প্রবীণ সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম বলে শব্দসৈনিক হিসেবে আমি মুক্তিযোদ্ধার একটি সনদ পেয়েছি। কিন্তু যঁারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, আত্মত্যাগ করেছেন বা নির্যাতিত হয়েছেন, তঁাদের সঙ্গে অন্যদের কোনো তুলনা হয় না। সে জন্য কে এম নুরুল হুদাকে নির্বাচন কমিশনে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে আমি গৌরব বোধ করি। নির্বাচন কমিশনে কাজ করতে এসে আজ পর্যন্ত তঁার সঙ্গে আমার কোনো মনোমালিন্য হয়নি। আমাদের পারস্পরিক সম্মানবোধে কখনো কোনো ঘাটতি পড়েনি। যঁারা বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতান্তর বা মনান্তর আশা করেন, তঁাদের কমিশনের বাকি ৫১ মাস নিরাশ হতে হবে বলে আমি মনে করি। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, নির্বাচন কমিশনে কেউ কারও ‘বস’ নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কমিশনে কোনো পৃথক ÿক্ষমতা নেই। কমিশনের সভায় তিনি তঁার সমান অধিকারের বিষয়ে সর্বদা সতর্ক থাকেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২–এর ধারা ৪ অনুযায়ী ‘কমিশন উহার চেয়ারম্যান বা উহার কোনো কর্মকর্তাকে এই আদেশের অধীন উহার সকল বা যেকোনো কর্তব্য বা দায়িত্ব পালন করিবার জন্যÿ ক্ষমতা অর্পণ করিতে পারিবে।’ এর অর্থ, পুরো কমিশন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দায়িত্ব না দিলে তিনি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। জাতীয় পার্টি বনাম নির্বাচন কমিশন মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ স্পষ্ট করে বলেছেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অধীনে যেকোনো দায়িত্ব পালন বা ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অবশ্যই কমিশন থেকে ক্ষমতপ্রাপ্ত হতে হবে, অন্যথায় তঁার কার্যক্রম এখতিয়ারবহির্ভূত হবে।’

মহামান্য রাষ্ট্রপতি তঁার প্রজ্ঞা, মনীষা ও অমূল্য বিবেচনাবোধ দিয়ে সার্চ কমিটির তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন নির্বাচন কমিশনারকে মনোনয়ন দিয়েছেন। সাংবিধানিক এই পদে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমরা একটি যৌথ সত্তা। স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত আমরা কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি। কোনো দিক থেকে কোনো চাপও আসেনি। ভবিষ্যতে জাতিকে অবাধ, সুষ্ঠু, সর্বজনগ্রহণযোগ্য ও অংশীদারমূলক নির্বাচন উপহার দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। সংবিধান সুষ্ঠু–নিরপেক্ষ নির্বাচনের বাইরে কোনো চিন্তা করতে পারে না এবং কোনো আইন বা বিধিবিধান সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের হাত বেঁধে দিলে তা সংবিধানসম্মত নয়।

এ ক্ষেত্রে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিখ্যাত রায়টির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ভারত সরকার ১৯৯৩ সালে তদানীন্তন সিইসি টি এন সেশনের সঙ্গে আরও দুজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ প্রদান করলে কমিশনে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। টি এন সেশন স্বয়ং ভারত সরকারের আদেশের বিরুদ্ধে রিট করেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায়ে বলেন যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কমিশনের সভাপতি এবং...‘সভাপতির দায়িত্ব হবে সভায় সভাপতিত্ব করা...তঁার দায়িত্ব হলো সভায় এমনভাবে আচরণ করা, যাতে তিনি তঁার সহকর্মীদের আস্থা ও সম্মতি অর্জন করতে পারেন। একজন সভাপতি এটি অর্জন করতে সক্ষম হবেন না, যদি তিনি কমিশনের অন্য সদস্যদের তঁার অধস্তন মনে করেন... যদি সিইসিকে ঊর্ধ্বতন হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এই অর্থে যে তঁার কথাই চূড়ান্ত, তাহলে তিনি পুরো কমিশনকেই অকার্যকর ও আলংকারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন।’

উল্লেখ্য, ভারত ও বাংলাদেশের সংবিধানিক বিধান প্রায় একই ধরনের। সবশেষে বলতে চাই, নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মধ্য দিয়েই জনগণের আস্থা অর্জন করতে চায়। এ ক্ষেত্রে সুধী সমাজ, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, সর্বোপরি নির্বাচনবিষয়ক লেখক ও অভিমত প্রদানকারীদের সবার সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য। সুষ্ঠু নির্বাচন কেবল নির্বাচন কমিশনের একক দায়িত্ব নয়, সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত সাহায্য-সহযোগিতা ও দায়িত্বশীল ভূমিকা ছাড়া এই প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব নয়।

মাহবুব তালুকদার : নির্বাচন কমিশনার।